তুলনার দর্পণে শকুন্তলা, মিরন্দা ও দেসদিমোনা: প্রেম, ভাগ্য ও নারীত্বের ভিন্ন রূপ ।। Shakuntala, Miranda and Desdemona in the mirror of comparison
তুলনার দর্পণে শকুন্তলা, মিরন্দা ও দেসদিমোনা: প্রেম, ভাগ্য ও নারীত্বের ভিন্ন রূপ
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের 'শকুন্তলা, মিরন্দা ও দেব্দিমোনা' প্রবন্ধটি তিনটি ভিন্ন সাহিত্যের, ভিন্ন সংস্কৃতির এবং ভিন্ন সময়ের তিন প্রধান নারী চরিত্রের এক গভীর ও সূক্ষ্ম তুলনামূলক বিশ্লেষণ। কালিদাসের 'অভিজ্ঞানশকুন্তলম', শেক্সপিয়ারের 'দ্য টেম্পেস্ট' এবং 'ওথেলো'—এই তিনটি কালজয়ী নাটকের নায়িকাদের নিয়ে বঙ্কিম যে আলোচনা করেছেন, তা কেবল তাদের বাহ্যিক মিল-অমিল তুলে ধরে না, বরং তাদের মনস্তত্ত্ব, চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য এবং তাদের পরিবেশের প্রভাবকেও অনবদ্য দক্ষতায় ব্যাখ্যা করে।
শকুন্তলা ও মিরন্দার সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য
বঙ্কিমচন্দ্র
প্রথমে শকুন্তলা
ও মিরন্দাকে
পাশাপাশি রেখে
আলোচনা করেছেন।
তাদের মধ্যে
কিছু সুস্পষ্ট
মিল রয়েছে।
উভয়েই ঋষিকন্যা
এবং অরণ্যে
প্রতিপালিত। শকুন্তলাকে
বিশ্বামিত্রের কন্যা
এবং কণ্বের
পালিতা কন্যা
হিসেবে উল্লেখ
করা হয়েছে,
এবং মিরন্দা
প্রস্পেরোর কন্যা।
বঙ্কিম তাদের
উভয়কেই 'বনলতা' হিসেবে আখ্যায়িত
করেছেন, যাদের সৌন্দর্য
উদ্যানলতাকে পরাজিত
করে। দুষ্মন্ত
শকুন্তলাকে দেখে
যেমন মুগ্ধ
হয়েছিলেন, তেমনি ফার্দিনান্দ
মিরন্দাকে দেখে
বিস্ময় প্রকাশ
করেছেন: "So perfect and so peerless,
are created / Of every creature’s best!"। উভয় চরিত্রের
মধ্যেই অকৃত্রিম
সারল্য বিদ্যমান।
তবে,
তাদের মধ্যে
গুরুত্বপূর্ণ বৈসাদৃশ্যও
রয়েছে। এই
পার্থক্য তাদের
শিক্ষাদীক্ষা, সামাজিক সংস্কার
এবং প্রেমের
প্রকাশভঙ্গিতে স্পষ্ট।
শকুন্তলা যদিও
সরল, তবুও তার
মধ্যে লোকালয়ের
সামাজিক সংস্কার
ও লজ্জা
বর্তমান। বঙ্কিমের
ভাষায়, "লজ্জা তাঁহার
চরিত্রে বড়
প্রবলা।" তিনি দুষ্মন্তের
সামনে সহজে
প্রণয় প্রকাশ
করতে পারেন
না, বরং লক্ষণেই
তার প্রেম
ব্যক্ত হয়।
যেমন: "স্নগ্ধং বীক্ষিতমন্যতোহপি নয়নে যৎ
প্রেয়ন্ত্যা তয়া,
/ যাতং যচ্চ
নিতম্বয়োর্গুরুতয়া মন্দং
বিলাসাদিব।" তার প্রণয়
প্রকাশ লুকোচুরি
খেলার মতো।
অন্যদিকে, মিরন্দা সামাজিক সংস্কার বা লোকলজ্জার কিছুই জানে না। তার পিতা ছাড়া আর কোনো পুরুষ সে দেখেনি। তাই ফার্দিনান্দকে দেখে তার মনে কোনো দ্বিধা বা লজ্জা জাগেনি। বঙ্কিম বলেছেন, "মিরন্দা এত সরলা যে, তাহার লজ্জাও নাই।" তার প্রণয় প্রকাশ অত্যন্ত সরাসরি এবং অকপট। ফার্দিনান্দের প্রতি তার অকুণ্ঠ প্রেম প্রকাশ পায় যখন তিনি বলেন, "I am your wife, if you will marry me; / If not, I’ll die your maid..."। বঙ্কিম মিরন্দার এই সারল্যকে "নবীনত্ব এবং মাধুর্য্য" অধিক বলে মনে করেছেন, কারণ তার পবিত্রতা সহজাত, সংস্কারপ্রসূত নয়।
শকুন্তলা ও দেসদিমোনার তুলনামূলক আলোচনা
বঙ্কিমচন্দ্র
শকুন্তলার চরিত্রের
আরেকটি দিক
উন্মোচন করতে
দেসদিমোনার সঙ্গে
তার তুলনা
করেছেন। তিনি
বলেছেন, শকুন্তলা আংশিকভাবে
মিরন্দা এবং
আংশিকভাবে দেসদিমোনা।
শকুন্তলা ও
দেসদিমোনা উভয়েই
গুরুজনের অনুমতি
ছাড়াই বীর
পুরুষের প্রেমে
পড়েছিলেন এবং
তাকে স্বামী
হিসেবে গ্রহণ
করেছিলেন। উভয়েরই
প্রণয় 'দুরারোহিণী আশালতা'র মতো মহামহীরুহকে
অবলম্বন করে
উঠেছিল।
তবে
তাদের চারিত্রিক
দৃঢ়তা এবং
দুঃখ ভোগের
প্রতিক্রিয়ায় ভিন্নতা
লক্ষ্য করা
যায়। স্বামী
কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত
হওয়ার পর
শকুন্তলার মধ্যে
এক ধরনের
তেজস্বিতা ও
আত্মসম্মানবোধ জাগ্রত
হয়েছিল। যখন
দুষ্মন্ত তাকে
অস্বীকার করেন,
তখন শকুন্তলা
"দলিতফণা সর্পের
ন্যায় মস্তক
উন্নত করিয়া
স্বামীকে ভর্ৎসনা"
করেছিলেন। তিনি
দৃঢ়তার সঙ্গে
বলেছিলেন, "অনার্য্য, আপনার হৃদয়ের
ভাবে সকলকে
দেখ?"
পক্ষান্তরে, দেসদিমোনার চরিত্রে চরম দুঃখ ও অপমান ভোগের মধ্যেও প্রেমের যে অবিচল নিষ্ঠা ও ক্ষমাশীলতা দেখা যায়, তা অতুলনীয়। ওথেলো যখন তাকে সবার সামনে অপমান করেন বা আঘাত করেন, দেসদিমোনা কেবল বলেন, "আমি দাঁড়াইয়া আপনাকে আর বিরক্ত করিব না।" এমনকি মৃত্যুর পূর্বেও তিনি তার স্বামীর প্রতি কোনো অভিযোগ না করে বলেন, "কেহ না, আমি নিজে। চলিলাম! আমার প্রভুকে আমার প্রণাম জানাইও।" বঙ্কিম দেসদিমোনার এই অবিচল ভক্তিকেই সতীত্বের সর্বোচ্চ রূপ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন, যা শকুন্তলার চরিত্রের তেজস্বিতার ঊর্ধ্বে।
উপসংহার: চিত্র বনাম সজীবতা
বঙ্কিমচন্দ্রের মতে, শকুন্তলা মিরন্দা
ও দেসদিমোনার
তুলনায় ভিন্ন
মাত্রার চরিত্র।
শকুন্তলা যেন
এক 'চিত্রকরের চিত্র',
যেখানে সৌন্দর্য
ও মাধুর্য
নিপুণভাবে ফুটিয়ে
তোলা হয়েছে।
তার দুঃখ
বা প্রণয়
প্রকাশ ইঙ্গিতে
এবং লক্ষণে
ব্যক্ত হয়েছে।
অন্যদিকে, দেসদিমোনা 'ভাস্করের গঠিত
সজীবপ্রায় গঠন'। তার আবেগ,
কষ্ট, এবং বেদনা
সম্পূর্ণ উন্মুক্ত
ও প্রত্যক্ষ।
বঙ্কিম বলেন,
"শকুন্তলার দুঃখের
বিস্তার দেখিতে
পাই না,
গতি দেখিতে
পাই না,
বেগ দেখিতে
পাই না;
সে সকল
দেস্দিমোনার
অত্যন্ত পরিস্ফুট।"
বঙ্কিম এই আলোচনায় শুধু নারী চরিত্রের বিশ্লেষণই করেননি, বরং নাটক ও উপাখ্যান কাব্যের পার্থক্যও তুলে ধরেছেন। তার মতে, শকুন্তলা ও মিরন্দা চরিত্রগুলো উপাখ্যান কাব্যের মতো, যেখানে সৌন্দর্য ও কল্পনার প্রাধান্য। কিন্তু দেসদিমোনার চরিত্রটি প্রকৃত নাটকের, যেখানে মানব হৃদয়ের গভীর সংঘাত, আবেগ এবং বাস্তবতার প্রতিফলন ঘটেছে। এই কারণে বঙ্কিমের কাছে দেসদিমোনা অধিকতর জীবন্ত ও প্রোজ্জ্বল চরিত্র, যার কাছে শকুন্তলা যেন এক প্রজ্জ্বলিত প্রদীপের নিচে ঢাকা পড়ে যাওয়া কলিকা মাত্র।
No comments