Header ads

বঙ্কিমচন্দ্রের চোখে সমাজ: 'বাবু' ও 'গর্দ্দভ' প্রবন্ধের তুলনামূলক আলোচনা ।। Bankim Chandra's 'Babu' and 'Gardava'

 বঙ্কিমচন্দ্রের চোখে সমাজ: 'বাবু' ও 'গর্দ্দভ' প্রবন্ধের তুলনামূলক আলোচনা

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের দুটি ব্যঙ্গাত্মক প্রবন্ধ 'বাবু' এবং 'গর্দ্দভ' উনিশ শতকের বাঙালি সমাজের দুটি ভিন্ন দিক নিয়ে রচিত। 'বাবু' প্রবন্ধে তিনি সেই সময়ের বাঙালি মধ্যবিত্ত সমাজের তথাকথিত 'বাবু' শ্রেণির চরিত্রকে তীক্ষ্ণ ব্যঙ্গের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন, আর 'গর্দ্দভ' প্রবন্ধে তিনি সমাজ, সাহিত্য রাজনীতির বিভিন্ন স্তরে ছড়িয়ে থাকা নির্বোধ, স্থূলবুদ্ধি অপ্রয়োজনীয় ব্যক্তিদের দিকে ইঙ্গিত করেছেন।

প্রবন্ধের বিষয়বস্তু

বঙ্কিমের 'বাবু' প্রবন্ধটি মহাভারতের কথোপকথনের ধাঁচে রচিত, যেখানে জনমেজয় মহর্ষি বৈশম্পায়নকে কলিযুগে আবির্ভূত হতে চলা 'বাবু' নামক একপ্রকার অদ্ভুত মনুষ্যদের সম্পর্কে জানতে চাইছেন। বৈশম্পায়ন নামক কল্পিত চরিত্রটির মুখ দিয়ে লেখক বাবুদের অদ্ভুত স্ববিরোধী চরিত্র বর্ণনা করেছেন।

'গর্দ্দভ' প্রবন্ধটি একটি অসাধারণ ব্যঙ্গাত্মক রচনা, যেখানে লেখক এক কল্পিত 'গাধা'কে (গর্দভ) উদ্দেশ্য করে তার পূজা করছেন। এই গর্দভ মূলত সেইসব নির্বোধ, অযোগ্য এবং স্থূলবুদ্ধির মানুষের প্রতীক, যারা সমাজে বিভিন্ন উচ্চপদ ক্ষমতা দখল করে বসে আছেন।

লেখকের প্রধান যুক্তি: বঙ্কিম বাবুদের প্রধানত কিছু অদ্ভুত বৈশিষ্ট্যের মাধ্যমে চিহ্নিত করেছেন। তাদের পোশাক-আশাক, চালচলন, ভাষা এবং মূল্যবোধ সবই ছিল ভণ্ডামি দুর্বলতায় ভরা। বাবুরা ছিলেন 'চসমাঅলঙ্কৃত, উদরচরিত্র, বহুভাষী, সন্দেশপ্রিয়' তারা বিদেশি ভাষার প্রতি আগ্রহী হলেও মাতৃভাষাকে অবজ্ঞা করতেন। এই শ্রেণীর মানুষেরা বিদ্যা অর্জন করতেন কেবল উপার্জনের জন্য, আর উপার্জনের উদ্দেশ্য ছিল কেবল সঞ্চয়। তাদের দশটি ইন্দ্রিয়ের মধ্যে কেবল রসনা (জিহ্বা) পবিত্র ছিল, যা দিয়ে তারা অন্যের নিন্দা করতেন।

লেখক 'গর্দ্দভ' প্রবন্ধে গাধাকে সর্বব্যাপী পূজনীয় হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন, সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে গাধারা বিদ্যমানবিচারালয়ে বিচারক হিসেবে, বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে, সাহিত্য সমালোচক হিসেবে। তাদের উচ্চপদ, মোটা মাইনে, স্তাবকদের দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে থাকার বর্ণনা দিয়ে তিনি আসলে সমাজের সেইসব অযোগ্য ব্যক্তিদের ক্ষমতার দম্ভ নির্বুদ্ধিতার দিকে ইঙ্গিত করেছেন।

মূল চরিত্রের বিশ্লেষণ: 'বাবু' প্রবন্ধে 'বাবু' শব্দটি একটি বিশেষ শ্রেণির মানুষের প্রতীক। বঙ্কিম দেখিয়েছেন, 'বাবু' শব্দটির নানা অর্থ আছেযেমন ইংরেজদের কাছে কেরানি বা বাজার সরকার, ধনীদের কাছে দরিদ্র, এবং ভৃত্যদের কাছে প্রভু। কিন্তু বঙ্কিমের মূল লক্ষ্য ছিল সেইসব 'বাবু'দের নিয়ে, যারা কেবল 'বাবু'গিরি করে জীবন কাটাতেন। এদের দশটি অবতারের কথা বলা হয়েছে, যেমন- কেরানি, ডাক্তার, উকিল, সম্পাদক, ইত্যাদি। প্রতিটি অবতারে তারা কোনো না কোনো 'অসুর'কে (যেমন- দপ্তরি, রোগী, মোয়াক্কেল) বধ করেন। এটি ছিল তাদের ক্ষমতার এক ব্যঙ্গাত্মক প্রকাশ।

'গর্দ্দভ' প্রবন্ধের 'গর্দ্দভ' চরিত্রটি কোনো সাধারণ গাধা নয়, বরং এটি অযোগ্যতা, নির্বুদ্ধিতা ক্ষমতার প্রতীক। লেখক বলেন, গর্দভের বড় পদ এবং উচ্চাসন রয়েছে। তার কান বিশাল, যা শুনে উকিলরা কাব্যরস ঢেলে দেয়। এর মাধ্যমে বঙ্কিম বুঝিয়েছেন, কীভাবে বিচারের আসনে বসে থাকা অযোগ্য ব্যক্তিরা আইনজীবীদের লম্বা-চওড়া কথা শুনে প্রভাবিত হন এবং ভুল বিচার করেন। গাধাকে রামায়ণে রাজা দশরথ, মহাভারতে যুধিষ্ঠির এবং কলিযুগে সমালোচক হিসেবে উল্লেখ করে লেখক বোঝাতে চেয়েছেন যে, নির্বুদ্ধিতা সব যুগেই এবং সব ক্ষেত্রেই ছিল।

লেখকের উদ্দেশ্য: বঙ্কিমের উদ্দেশ্য ছিল এই বাবু সংস্কৃতির অন্তঃসারশূন্যতা ভণ্ডামি তুলে ধরা। তিনি দেখাতে চেয়েছেন যে, এই শ্রেণির মানুষরা বাইরের দিক থেকে আধুনিক শিক্ষিত হলেও তাদের মূল্যবোধ নৈতিকতা ছিল শূন্য। তাদের বিশ্বাস ছিল যে, তামাকু সেবন করে, দ্বৈভাষিক কথা বলে এবং আলস্যে সময় কাটিয়েই তারা দেশের উন্নতি ঘটাবে, যা আসলে এক চরম ভুল ধারণা।

'গর্দ্দভ' প্রবন্ধের উদ্দেশ্য ছিল সামাজিক রাজনৈতিক অযোগ্যতা, নির্বুদ্ধিতা দুর্নীতিকে ব্যঙ্গ করা। তিনি দেখাতে চেয়েছেন, যারা নিজেদের বুদ্ধিমান মনে করেন, তারাও আসলে গাধার মতোই আচরণ করছেন। এই প্রবন্ধে তিনি সমাজের বিভিন্ন স্তরে ছড়িয়ে থাকা ভণ্ডামি, অজ্ঞতা এবং যোগ্যতাহীনতার উপর কঠোর আঘাত হেনেছেন। গর্দভের প্রশংসা করার ছলে তিনি আসলে এই ধরনের ব্যক্তিদের নিন্দা করেছেন।

প্রবন্ধ দুটির গঠন শৈলী

দুটি প্রবন্ধেরই গঠনশৈলী ব্যঙ্গাত্মক। 'বাবু' প্রবন্ধটি মহাভারতের ধাঁচে লেখা, আর 'গর্দ্দভ' প্রবন্ধটি গর্দভের প্রতি স্তুতিমূলক রচনার মতো। উভয় প্রবন্ধেই বঙ্কিম ভাষার তীক্ষ্ণতা, শ্লেষ উপমার মাধ্যমে হাস্যরস সৃষ্টি করেছেন। তিনি অলঙ্কার ব্যবহার করে তার বক্তব্যকে আরও কার্যকর করে তুলেছেন। 'বাবু' প্রবন্ধে তিনি 'অগস্ত্য', 'বিষ্ণু' ইত্যাদি পৌরাণিক চরিত্রদের সঙ্গে বাবুদের তুলনা করে তাদের কর্ম আচরণের অসঙ্গতি ফুটিয়ে তুলেছেন। 'গর্দ্দভ' প্রবন্ধে তিনি 'ভৈরবকণ্ঠ', 'মহাপৃষ্ঠ' ইত্যাদি শব্দের মাধ্যমে গাধার প্রতি স্তুতি করে আদতে তার নির্বুদ্ধিতা তুলে ধরেছেন। দুটি প্রবন্ধই বঙ্কিমের ব্যঙ্গ রচনার শ্রেষ্ঠ নিদর্শন, যেখানে তিনি কৌতুক কঠোর সমালোচনাকে একত্রিত করেছেন।

No comments

Theme images by Maliketh. Powered by Blogger.