Header ads

সরলতাই শ্রেষ্ঠ অলঙ্কার এবং দুর্বোধ্যতা থেকে মুক্তি: বঙ্কিমচন্দ্রের 'বাঙ্গালা ভাষা' প্রবন্ধের মূলকথা ।। Bankim Chandra's 'Bengali Language'

 সরলতাই শ্রেষ্ঠ অলঙ্কার এবং দুর্বোধ্যতা থেকে মুক্তি: বঙ্কিমচন্দ্রের 'বাঙ্গালা ভাষা' প্রবন্ধের মূলকথা

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত বাঙ্গালা ভাষা প্রবন্ধটি বাংলা সাহিত্য এবং ভাষার বিবর্তনের এক গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা। এই প্রবন্ধে তিনি লিখিত কথিত ভাষার মধ্যেকার পার্থক্য, সাধু চলিত ভাষার দ্বন্দ্ব, এবং একটি আদর্শ গদ্য রচনারীতি কেমন হওয়া উচিত, তা নিয়ে গভীর আলোচনা করেছেন। প্রবন্ধটির মূলভাব হলো ভাষার উদ্দেশ্য উপযোগিতাভিত্তিক প্রয়োগ এবং সরলতা স্পষ্টতার গুরুত্ব।

বঙ্কিমচন্দ্র তার প্রবন্ধে প্রথমেই লিখিত এবং কথিত ভাষার মধ্যেকার পার্থক্য তুলে ধরেন। তিনি বলেন, "প্রায় সকল দেশেই লিখিত ভাষা এবং কথিত ভাষায় অনেক প্রভেদ।" তিনি দেখান যে, সে সময়ে বাংলায় দুটি পৃথক ভাষার ধারা প্রচলিত ছিল: একটি ছিল সাধুভাষা, যা ছিল সংস্কৃতবহুল এবং কেবল লেখার কাজে ব্যবহৃত হতো; অন্যটি ছিল অপর ভাষা বা প্রচলিত ভাষা, যা সাধারণ মানুষ দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহার করত। বঙ্কিমের মতে, সংস্কৃত-ব্যবসায়ী পণ্ডিতদের হাতে বাংলা রচনার দায়িত্ব থাকায় সাধুভাষা অত্যন্ত নীরস, দুর্বোধ্য এবং সাধারণ মানুষের কাছে অপরিচিত হয়ে ওঠে। তারা মনে করত, "ভাষা সুন্দর হউক বা না হউক, দুর্ব্বোধ্য সংস্কৃতবাহুল্য থাকিলেই রচনার গৌরব হইল।"

এই স্থবিরতার অবসান ঘটান প্যারিচাঁদ মিত্র (টেকচাঁদ ঠাকুর) তাঁর আলালের ঘরের দুলাল রচনার মাধ্যমে। বঙ্কিম তাঁর এই প্রয়াসকে সাধুবাদ জানিয়ে বলেন, "সেই দিন হইতে বাঙ্গালা ভাষার শ্রীবৃদ্ধি। সেই দিন হইতে শুষ্ক তরুর মূলে জীবনবারি নিষিক্ত হইল।" এই রচনার পর থেকেই বাংলা সাহিত্যে সাধু প্রচলিত, উভয় ভাষাই ব্যবহৃত হতে থাকে, যা সংস্কৃতবাদীদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। বঙ্কিম এই দুই সম্প্রদায়ের মতামতের বিশ্লেষণ করে তার নিজস্ব মত প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি রামগতি ন্যায়রত্নের মতো সংস্কৃতবাদীদের সমালোচনা করেন, যারা প্রচলিত ভাষাকে "গুরুজনসমক্ষে উচ্চারণ করিতে লজ্জা বোধ হয়" বলে দূরে সরিয়ে রাখতে চেয়েছিলেন। বঙ্কিম এর প্রতিবাদ করে বলেন, "সরল ভাষাই শিক্ষাপ্রদ।" তাঁর মতে, যে ভাষা বুঝতে না পারা যায়, তা থেকে কোনো শিক্ষা লাভ করা সম্ভব নয়।

প্রবন্ধে বঙ্কিমচন্দ্র আধুনিক বা নব্য সম্প্রদায়ের বাড়াবাড়িরও সমালোচনা করেছেন, যেমন শ্যামাচরণ গঙ্গোপাধ্যায়-এর মতো লেখকদের, যারা অপ্রয়োজনীয়ভাবে সংস্কৃত শব্দকে বাংলা থেকে বাদ দিতে চেয়েছিলেন। বঙ্কিম এই মতের বিরোধিতা করে বলেন, যে প্রচলিত হইয়াছে, তাহার উচ্ছেদে কোন ফল নাই এবং উচ্ছেদ সম্ভবও নহে। তিনি মনে করেন, ভাষা থেকে প্রচলিত শব্দ বাদ দেওয়া মানে ভাষাকে ধনশূন্য করা। তাঁর মতে, “ভাইযেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনিভ্রাতাশব্দটিও প্রয়োজন, কারণ এই শব্দগুলোর ভিন্ন ভিন্ন আবেগ গভীরতা রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ তিনিভ্রাতৃভাবভাইভাবএর তুলনা করেন।

বঙ্কিমচন্দ্রের মতে, ভাষার প্রধান উদ্দেশ্য হলো পাঠকের কাছে বক্তব্যকে স্পষ্ট সুন্দরভাবে উপস্থাপন করা। তিনি বলেন, সাহিত্য কি জন্য? গ্রন্থ কি জন্য ? যে পড়িবে, তাহার বুঝিবার জন্য। তাই লেখকের উচিত সেই ভাষা ব্যবহার করা যা অধিকাংশ মানুষের কাছে বোধগম্য। যারা কেবল পণ্ডিতদের জন্য দুরূহ ভাষায় লেখেন, তাদের তিনি "পরোপকারকাতর খলস্বভাব পাষণ্ড" বলে অভিহিত করেন।

তবে বঙ্কিমচন্দ্র শুধুমাত্র চলিত বা হুতোমি ভাষার পক্ষও নেননি। তিনি বলেন, হুতোমি ভাষা দরিদ্র, ইহার তত শব্দধন নাই; হুতোমি ভাষা নিস্তেজ, ইহার তেমন বাঁধন নাই। তাই কেবল হুতোমি ভাষায় মহৎ উদ্দেশ্য সিদ্ধ হতে পারে না। তিনি এর পরিবর্তে একটি সমন্বয়বাদী রীতির প্রস্তাব করেন। তিনি বলেন, বিষয় অনুসারেই রচনার ভাষার উচ্চতা বা সামান্যতা নির্দ্ধারিত হওয়া উচিত। রচনার প্রধান গুণ হলো সরলতা এবং স্পষ্টতা। যদি প্রচলিত ভাষা দিয়ে এই উদ্দেশ্য সফল হয়, তবে সেটিই ব্যবহার করা উচিত। যদি তাতে না হয়, তবে সংস্কৃতবহুল ভাষার আশ্রয় নিতে হবে।

বঙ্কিম চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে বলেন যে, লেখকের উচিত তার বক্তব্যকে "পরিস্ফুট" করে বলা। প্রয়োজনে "ইংরেজি ফার্সি, আর্বি, সংস্কৃত, গ্রাম্য, বন্য, যে ভাষার শব্দ প্রয়োজন, তাহা গ্রহণ করিবে, অশ্লীল ভিন্ন কাহাকেও ছাড়িবে না।" এই সমন্বয়বাদী নীতিই ভাষাকে শক্তিশালী, শব্দৈশ্বর্যে পুষ্ট এবং সাহিত্যের অলঙ্কারে বিভূষিত করবে। বঙ্কিমচন্দ্রের এই প্রবন্ধ বাংলা ভাষার আধুনিকীকরণে এক অমূল্য ভূমিকা পালন করে, যেখানে তিনি ঐতিহ্য এবং আধুনিকতার মধ্যে এক ভারসাম্যপূর্ণ পথ নির্দেশ করেন।

No comments

Theme images by Maliketh. Powered by Blogger.