অনুকরণ, আত্মবিস্মৃতি এবং ঔপনিবেশিকতার ফসল 'বাবু': বঙ্কিমচন্দ্রের শ্লেষের আড়ালে লুকিয়ে থাকা বেদনা ।। Bankim Chandra's 'Babu'
অনুকরণ, আত্মবিস্মৃতি এবং ঔপনিবেশিকতার ফসল 'বাবু': বঙ্কিমচন্দ্রের শ্লেষের আড়ালে লুকিয়ে থাকা বেদনা
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত ‘বাবু’ প্রবন্ধটি বাংলা সাহিত্যের একটি শ্রেষ্ঠ ব্যঙ্গ রচনা। বঙ্কিমের এই লেখায় আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত এক শ্রেণির বাঙালির চরিত্রকে তীক্ষ্ণ শ্লেষ এবং ব্যঙ্গাত্মক ভাষায় তুলে ধরা হয়েছে, যারা নিজেদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বিদেশি রীতিনীতির অনুকরণে মত্ত ছিল। 'মহাভারত' রচনারীতি অনুসরণ করে জনমেজয় ও বৈশম্পায়নের কথোপকথনের মাধ্যমে লেখক এই 'বাবু' নামক চরিত্রের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করেছেন। এই প্রবন্ধের মূলভাব হলো বাঙালি সমাজে উদ্ভূত এক ভণ্ড, আত্মবিস্মৃত এবং অন্তঃসারশূন্য শ্রেণির কঠোর সমালোচনা।
প্রবন্ধের শুরুতেই বৈশম্পায়ন এই বাবুদের পরিচয় দিতে গিয়ে বলেন, “আমি সেই চস্মাঅলঙ্কৃত, উদরচরিত্র, বহুভাষী, সন্দেশপ্রিয় বাবুদিগের চরিত্র কীর্ত্তিত করিতেছি, আপনি শ্রবণ করুন।” এই উক্তির মাধ্যমে বঙ্কিম বাবুদের বাহ্যিক বৈশিষ্ট্যগুলো তুলে ধরেন। তিনি বাবুদেরকে এমন এক শ্রেণির মানুষ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন, যারা মাতৃভাষায় কথা বলতে লজ্জিত, কিন্তু বিদেশি ভাষায় পারদর্শী। তিনি বলেছেন, “যাঁহারা বাক্যে অজেয়, পরভাষাপারদর্শী, মাতৃভাষাবিরোধী, তাঁহারাই বাবু।” এই বাক্যটি বাবুদের সাংস্কৃতিক দ্বিচারিতা এবং আত্মবিস্মৃতির গভীরতা প্রকাশ করে।
বঙ্কিমচন্দ্র বাবুর চরিত্রের নৈতিক ও সামাজিক দিকগুলোও কঠোরভাবে সমালোচনা করেছেন। তিনি তাদের উপার্জনের নীতিহীনতাকে ব্যঙ্গ করে বলেন, “যাঁহারা বিনা উদ্দেশ্যে সঞ্চয় করিবেন, সঞ্চয়ের জন্য উপার্জ্জন করিবেন, উপার্জ্জনের জন্য বিদ্যাধ্যয়ন করিবেন, বিদ্যাধ্যয়নের জন্য প্রশ্ন চুরি করিবেন, তাঁহারাই বাবু।” এই উক্তিটি তাদের শিক্ষাব্যবস্থা ও মূল্যবোধের অবক্ষয়ের প্রতি ইঙ্গিত করে। তাদের কর্মহীনতা, বিলাসবহুল জীবনযাত্রা এবং দায়িত্বহীনতার চিত্রও লেখক ফুটিয়ে তুলেছেন।
প্রবন্ধটিতে বঙ্কিম বিভিন্ন রূপক ও শ্লেষের আশ্রয় নিয়েছেন। তিনি বলেন, বাবুরা "অগ্নির" উপাসনা করে থাকেন। এই অগ্নি “তামাকু” এবং “চুরুট” রূপে তাদের মুখে বিরাজ করে, “মদন আগুন” বা “মনাগুন” রূপে সঙ্গীতে প্রকাশ পায় এবং বিলাসিতার প্রতীক হিসেবে তাদের রথে বা প্রদীপে জ্বলতে থাকে। এই রূপকগুলোর মাধ্যমে লেখক বাবুদের বিলাসী জীবন, আসক্তি এবং নৈতিক স্খলনের দিকে ইঙ্গিত করেছেন। তাদের “বায়ুসেবন” নামক ভদ্রোচিত অলসতা, এবং যমকে ভুলিয়ে থাকার মতো আচরণে বঙ্কিমের ব্যঙ্গ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
বঙ্কিমবাবু এই শ্রেণির জ্ঞান, ধর্ম এবং নৈতিকতার অভাবকেও তীব্রভাবে বিদ্রূপ করেছেন। তিনি বলেন, “যিনি কাব্যের কিছুই বুঝিবেন না, অথচ কাব্যপাঠে এবং সমালোচনায় প্রবৃত্ত, যিনি বারযোষিতের চীৎকার মাত্রকেই সঙ্গীত বিবেচনা করিবেন, যিনি আপনাকে অভ্রান্ত বলিয়া জানিবেন, তিনিই বাবু।” এই উক্তিটি তাদের অগভীর জ্ঞান ও আত্মম্ভরিতার পরিচয় বহন করে। ধর্মীয় বিশ্বাসের ক্ষেত্রেও বাবুদের দ্বিচারিতা প্রকট। তারা “মিশনরির নিকট খ্রীষ্টিয়ান, কেশবচন্দ্রের নিকট ব্রাহ্ম, পিতার নিকট হিন্দু, এবং ভিক্ষুক ব্রাহ্মণের নিকট নাস্তিক,”। এই বর্ণনা তাদের সুবিধাবাদী ধর্মবিশ্বাস এবং যেকোনো মূল্যে নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করার মানসিকতার পরিচায়ক।
বঙ্কিমচন্দ্র হিন্দু দেবদেবীর সঙ্গে বাবুদের তুলনা করে তাঁদের চরিত্রকে আরও হাস্যকর ও তুচ্ছ করেছেন। বিষ্ণুর দশ অবতারের সঙ্গে বাবুদের দশ অবতারের (কেরাণী, মাষ্টার, উকিল, জমিদার ইত্যাদি) তুলনা করে তিনি দেখিয়েছেন, কীভাবে এই বাবুরা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য বিভিন্ন রূপে আবির্ভূত হন এবং দুর্বল ও নিরীহ মানুষকে শোষণ করেন। যেমন, “জমিদার অবতারে বধ্য প্রজা; সম্পাদক অবতারে বধ্য ভদ্রলোক এবং নিষ্কর্ম্মাবতারে বধ্য পুষ্করিণীর মৎস্য।”
প্রবন্ধের শেষে বঙ্কিম বাবুদের চূড়ান্ত আত্মপ্রবঞ্চনার দিকে ইঙ্গিত করে বলেন, “তাঁহাদের মনে মনে বিশ্বাস জন্মিবে যে, আমরা তাম্বূল চর্ব্বণ করিয়া উপাধান অবলম্বন করিয়া দ্বৈভাষিকী কথা কহিয়া, এবং তামাকু সেবন করিয়া ভারতবর্ষের পুনরুদ্ধার করিব।” এই ব্যঙ্গাত্মক মন্তব্যের মাধ্যমে লেখক দেখিয়েছেন যে, এই শ্রেণির মানুষরা দেশ ও সমাজের প্রতি তাদের দায়িত্ব সম্পূর্ণরূপে ভুলে গিয়েছেন এবং নিষ্ক্রিয় বিলাসে মত্ত হয়ে নিজেদেরকে দেশপ্রেমিক মনে করার এক ভ্রান্ত জগতে বাস করেন।
সামগ্রিকভাবে, 'বাবু' প্রবন্ধটি বঙ্কিমচন্দ্রের সমাজ-সচেতন মননের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তিনি এই প্রবন্ধের মাধ্যমে উনিশ শতকের বাঙালি সমাজের এক নির্দিষ্ট শ্রেণির অন্তঃসারশূন্যতা, ভণ্ডামি এবং সাংস্কৃতিক অবক্ষয়কে নির্মমভাবে তুলে ধরেছেন, যা আজও প্রাসঙ্গিক।
No comments