Header ads

বঙ্কিমচন্দ্রের 'গর্দ্দভ': গাধা কি সত্যিই গাধা? Bankim Chandra's 'Gardava'

 বঙ্কিমচন্দ্রের 'গর্দ্দভ': গাধা কি সত্যিই গাধা?

    বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের 'গর্দ্দভ' প্রবন্ধটি বাংলা সাহিত্যের একটি বিখ্যাত ব্যঙ্গ রচনা, যেখানে তিনি একটি নিরীহ প্রাণীকে রূপক হিসেবে ব্যবহার করে সমাজের বিভিন্ন স্তরের ভণ্ড, নির্বোধ এবং অযোগ্য ব্যক্তিদের তীব্র সমালোচনা করেছেন। এই প্রবন্ধের মূলভাব হলো সমাজের সেইসব মানুষের প্রতি তীক্ষ্ণ বিদ্রূপ, যারা তাদের অযোগ্যতা, অলসতা এবং স্বাচ্ছন্দ্যপ্রিয়তার কারণে সমাজের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত হয়েছেন, এবং এর মাধ্যমে সমাজকে ক্ষতিগ্রস্ত করছেন।

প্রবন্ধের শুরুতেই লেখক একটি গর্দভকে সম্বোধন করে তার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করছেন, কিন্তু এই শ্রদ্ধা নিবেদন আসলে গভীর ব্যঙ্গ। তিনি বলেন, হে গর্দ্দভ! আমার প্রদত্ত, এই নবীন সকল ভোজন করুন... কেন না, আপনাকেই সর্ব্বত্র দেখিতে পাই। অতএব হে বিশ্বব্যাপিন্! আমার পূজা গ্রহণ করুন। এই উক্তিটির মাধ্যমে বঙ্কিম বোঝাতে চেয়েছেন যে, গর্দভরূপী অযোগ্য মূর্খ ব্যক্তিরা সমাজের এমন সর্বব্যাপী গুরুত্বপূর্ণ স্থানে বসে আছে যে, তাদের পূজা করা ছাড়া যেন কোনো উপায় নেই।

বঙ্কিম গর্দভের গুণাবলী বর্ণনা করতে গিয়ে সমাজের বিভিন্ন অংশের অযোগ্য ব্যক্তিদের চিত্র তুলে ধরেছেন। তিনি বলেন, তুমিই বিচারাসনে উপবেশন করিয়া, মহাকর্ণদ্বয় ইতস্ততঃ সঞ্চালন করিতেছ। এই বাক্যের মাধ্যমে তিনি বিচারকদের অজ্ঞতা নিষ্ক্রিয়তাকে বিদ্রূপ করেছেন। বিচারকের বিশাল কানের গহ্বরে উকিলদের কাব্যরস ঢেলে দেওয়ার কথা বলে তিনি আদালতের বিচারপ্রক্রিয়ার অসারতা হাস্যকর দিকটি তুলে ধরেছেন। বিচারকের নিষ্ক্রিয়তা এমন যে, তিনি ঘুমিয়ে থাকেন এবং রামের সর্ব্বস্ব শ্যামকে দাও, শ্যামের সর্ব্বস্ব কানাইকে দাও। এমন মন্তব্যে বিচারকের বিবেকহীনতা দায়িত্বজ্ঞানহীনতার প্রতি কটাক্ষ করা হয়েছে।

শিক্ষাব্যবস্থার প্রতিও বঙ্কিম তীক্ষ্ণ তীর ছুড়েছেন। তিনি গর্দভকে সরস্বতীমণ্ডপমধ্যে বঙ্গীয় বালকগণকে গর্দ্দভলোক প্রাপ্তির উপায় বলিয়া দিতেছ বলে বর্ণনা করেছেন। এই উক্তিটি সেইসব শিক্ষকদের প্রতি ব্যঙ্গ, যারা ছাত্রদের যথার্থ জ্ঞান না দিয়ে কেবল পরীক্ষায় পাশ করার কৌশল শেখান এবং তাদের গর্দভের মতো অযোগ্য স্থবির করে তোলেন। তিনি আরও বলেন, “বালকেরা গর্দ্দভলোকে প্রবেশ করিলে, “প্রবেশিকায় উত্তীর্ণ হইলবলিয়া, মহা গর্জ্জন করিয়া থাক। এর মধ্য দিয়ে পরীক্ষার ফলাফলের উপর অতিরিক্ত গুরুত্বারোপ করার প্রবণতার সমালোচনা করা হয়েছে।

বঙ্কিমচন্দ্র এই প্রবন্ধের মাধ্যমে কেবল ব্যক্তিবিশেষকে নয়, বরং সমাজের সামগ্রিক অবক্ষয়কেই তুলে ধরেছেন। তিনি বলেন, “তুমি নানা রূপে, নানা দেশ আলো করিয়া যুগে যুগে প্রতিষ্ঠিত হইয়াছ। এর মাধ্যমে তিনি বোঝাতে চেয়েছেন যে, মূর্খতা অযোগ্যতা কোনো নির্দিষ্ট সময়ের বা স্থানের সমস্যা নয়, বরং এটি একটি চিরন্তন সামাজিক ব্যাধি। সমালোচকদেরকেও তিনি গর্দভের সঙ্গে তুলনা করে বলেন, তুমি বঙ্গদেশে সমালোচক হইয়া অবতীর্ণ হইয়াছ। এই মন্তব্যটি সেইসব সমালোচকদের প্রতি ইঙ্গিত করে, যারা সাহিত্য বা শিল্পকর্মের প্রকৃত মর্ম না বুঝে কেবল স্থূল নেতিবাচক মন্তব্য করেন।

প্রবন্ধের শেষের দিকে বঙ্কিম গর্দভের কিছু গুণাবলী বর্ণনা করেন, যা আসলে তার দুর্বলতা অসারতার প্রতি ব্যঙ্গ। তিনি বলেন, বিধাতা তোমায় তেজ দেন নাই, এজন্য তুমি শান্ত, বেগ দেন নাই, এজন্য সুধীর, বুদ্ধি দেন নাই, এজন্য তুমি বিদ্বান্; এবং মোট না বহিলে খাইতে পাও না, এজন্য তুমি পরোপকারী। এই কথাগুলোর মধ্য দিয়ে বঙ্কিম বোঝাতে চেয়েছেন যে, গর্দভরূপী এই মানুষগুলোর তথাকথিত 'গুণ' আসলে তাদের অলসতা, ভীরুতা এবং অযোগ্যতারই ফল।

সবশেষে বলা যায়, 'গর্দ্দভ' প্রবন্ধটি বঙ্কিমচন্দ্রের ব্যঙ্গাত্মক রচনার এক শ্রেষ্ঠ উদাহরণ। এই প্রবন্ধের মধ্য দিয়ে তিনি সমাজের বিভিন্ন স্তরের ভণ্ডামি, অজ্ঞতা এবং দায়িত্বজ্ঞানহীনতার চিত্র তুলে ধরেছেন। গর্দভকে রূপক হিসেবে ব্যবহার করে তিনি এমন এক শ্রেণির মানুষের সমালোচনা করেছেন, যারা সমাজের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসেও কোনো সৃষ্টিশীল বা কার্যকরী ভূমিকা পালন করে না, বরং নিষ্ক্রিয় নির্বোধের মতো দিন কাটায়।

 

No comments

Theme images by Maliketh. Powered by Blogger.