রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'শ্রাবণসন্ধ্যা': প্রকৃতির সুর ও মানুষের মনের সম্পর্ক ।। Rabindranath Tagore's 'Shravan Sandhya'
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'শ্রাবণসন্ধ্যা': প্রকৃতির সুর ও মানুষের মনের সম্পর্ক
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'শ্রাবণসন্ধ্যা' প্রবন্ধটি মূলত প্রকৃতি, বিশেষ করে বর্ষা ঋতুর সঙ্গে মানুষের মনের গভীর সম্পর্কের এক কাব্যিক ও দার্শনিক ব্যাখ্যা। প্রবন্ধের শুরুতেই লেখক শ্রাবণের অবিরাম ধারাবর্ষণের কথা বলেন, যা পৃথিবীর সমস্ত কোলাহলকে ডুবিয়ে দিয়ে এক নিবিড়, মৌন এবং গভীর অন্ধকারময় জগতের সৃষ্টি করেছে। এই নীরব অন্ধকারকে যেন একমাত্র শ্রাবণের ঝরঝর শব্দই ভাষা দিতে পারে। এই শব্দ কোনো সাধারণ শব্দ নয়, এটি যেন 'শব্দের অন্ধকার', যা বিশ্বজগতের নিদ্রাকে আরও নিবিড় করে তোলে। এই কর্মহীন সন্ধ্যায় শ্রাবণের এই অবিরাম শব্দকে লেখক এক জপমন্ত্রের সঙ্গে তুলনা করেছেন, যা বিরতিহীনভাবে উচ্চারিত হতে থাকে। এটি যেন বোবা প্রকৃতির হঠাৎ কণ্ঠ খুলে যাওয়া, যা তার নিজের কথাই নিজে শুনে চলেছে।
এই অবিরাম বর্ষণের সাড়া মানুষের মনেও জাগে। মনও যেন এই বর্ষণের মতো বিশাল ও গভীর কিছু বলতে চায়, কিন্তু তা মুখের কথায় সম্ভব নয়। কারণ, প্রকৃতি তার মনের কথা স্পষ্ট ভাষায় বলে না; সে প্রকাশ করে আভাসে, ইঙ্গিতে, ছবি আর গানে। এই কারণেই প্রকৃতি যখন কথা বলে, তখন মানুষের মুখের ভাষা স্তব্ধ হয়ে যায় এবং মনের গভীরে এক অনির্বচনীয় গানের জন্ম হয়। লেখক মনে করেন, কথা হলো মানুষের নিজস্ব, যা সুনির্দিষ্ট ও সীমাবদ্ধ। অন্যদিকে, গান হলো প্রকৃতির, যা অস্পষ্ট ও সীমাহীন ব্যাকুলতায় পূর্ণ। তাই কথায় মানুষ মানুষের সঙ্গে যুক্ত হয়, আর গানে মানুষ বিশ্বপ্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হয়। যখন মানুষ কথার সঙ্গে সুরের সংযোগ ঘটায়, তখন সেই কথা তার সাধারণ অর্থকে অতিক্রম করে এক বিশাল ব্যঞ্জনা লাভ করে। মানুষের সুখ-দুঃখ তখন আকাশের মতো বিশাল হয়ে ওঠে, যা জগতের বিরাট অব্যক্তের সঙ্গে যুক্ত হয়ে এক মহৎ রূপ ধারণ করে।
প্রবন্ধে লেখক মানুষের মন এবং প্রকৃতির চিরন্তন ভাষার মিলনের চেষ্টার কথা বলেছেন। মানুষ প্রকৃতির রং ও রেখা থেকে ছবি তৈরি করে এবং সুর ও ছন্দ থেকে কাব্য রচনা করে। এভাবেই মানুষের চিন্তা অসীমের দিকে ধাবিত হয় এবং তার অনুভূতিগুলো নিত্য ব্যবহারের সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে চিরন্তনের সঙ্গে যুক্ত হয়। এই বর্ষার সন্ধ্যায় প্রকৃতির শ্রাবণ-অন্ধকারের ভাষা মানুষের মনের ভাষার সঙ্গে মিলে যেতে চাইছে। অব্যক্ত আজ ব্যক্তের সঙ্গে লীলা করার জন্য মানুষের দ্বারে আঘাত করছে। এই মুহূর্তে কোনো যুক্তি, তর্ক বা বিশ্লেষণ কাজে আসবে না। কেবল গানই একমাত্র ভাষা। তাই লেখক সবাইকে আহ্বান জানিয়েছেন সংসারের কাজ থেকে মনকে সরিয়ে নিয়ে এই শ্রাবণের ধারাবর্ষণকে মুক্ত মনে বরণ করে নিতে।
প্রবন্ধের দ্বিতীয় অংশে রবীন্দ্রনাথ প্রকৃতির দুই রূপের কথা তুলে ধরেছেন – বাইরের কর্মময় রূপ এবং মানুষের অন্তরের শান্তিময় রূপ। তিনি গাছের ফুলের উদাহরণ দিয়েছেন। বাইরে প্রকৃতির জগতে ফুলকে কঠোর পরিশ্রম করতে হয়, বংশরক্ষার জন্য ফল ফলাতে হয়। তার রঙ, গন্ধ— সবই এক সুনির্দিষ্ট কাজের অংশ। কিন্তু সেই একই ফুল যখন মানুষের অন্তরে প্রবেশ করে, তখন সে কোনো কাজের তাড়না নিয়ে আসে না, বরং সৌন্দর্য ও শান্তির প্রতীক হয়ে ওঠে।
লেখক বিজ্ঞান এবং হৃদয়ের এই ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির তুলনা করেছেন। বিজ্ঞান বলে, ফুলের একমাত্র উদ্দেশ্য কাজ করা। কিন্তু মানুষের হৃদয় এর জবাবে বলে, ফুল একই সঙ্গে বাইরে কাজের পরিচয়পত্র নিয়ে আসে এবং অন্তরে সৌন্দর্যের পরিচয়পত্র নিয়ে প্রবেশ করে। একটি পরিচয় বন্দীর মতো, অন্যটি মুক্তস্বরূপ। উভয়েই সত্য।
রবীন্দ্রনাথ ফুলকে এক প্রিয়তমের দূতের সঙ্গে তুলনা করেছেন, যে 'সংসারের সোনার লঙ্কায়' নির্বাসিত মানুষের কাছে আসে। ফুল যেন রামচন্দ্রের আঙটির মতো এক চিহ্ন নিয়ে আসে, যা দেখে মানুষ বুঝতে পারে যে সে একা নয়, বরং একজন প্রিয়তম (ঈশ্বর বা সুন্দর) তাকে স্মরণ করেন এবং মুক্তির জন্য অপেক্ষা করছেন। ফুলের এই সৌন্দর্য, তার রঙ ও গন্ধ মানুষের মনে সেই প্রিয়তমের আনন্দময় স্পর্শ জাগিয়ে তোলে। এভাবেই ফুল মানুষের কাছে আসে প্রেমের চিঠি নিয়ে, যেখানে প্রকৃতির প্রয়োজনের ভাষা রূপান্তরিত হয় আনন্দের ভাষায়।
সবশেষে, লেখক এই শ্রাবণের ধারাপাতকে শুধুমাত্র একটি সন্ধ্যার বর্ষণ হিসেবে দেখেননি, বরং তাকে সমগ্র জীবনের এক বিরহ-সন্ধ্যা হিসেবে অনুভব করেছেন। এই বিরহ সম্পূর্ণ শূন্য নয়, বরং এর গভীরে এক নিবিড় রস লুকানো আছে। এই বিরহের মূল কারণ হলো সেই চিরদিনের প্রিয়তম 'হরি'র অনুপস্থিতি। বিরহ হলো মিলনেরই একটি অঙ্গ। তাই, 'হরি বিনে কৈসে গোঙায়বি দিনরাতিয়া'— বিদ্যাপতির এই গানটি শ্রাবণের ধারাপাতের মধ্য দিয়ে বারবার উচ্চারিত হয়। এই বিরহের সুরেই লেখক অনুভব করেন, যাকে তিনি পাননি, তিনিও আছেন। এই বিশ্বাসই সমস্ত বেদনা ও বিরহের মধ্যেও এক গভীর আনন্দ ও মুক্তির আভাস নিয়ে আসে।
No comments