রবীন্দ্রনাথের 'সাহিত্য'প্রবন্ধ: সাহিত্যের প্রাণসত্তা ও সংজ্ঞা ।। Rabindranath's essay 'Sahitya'
রবীন্দ্রনাথের 'সাহিত্য'প্রবন্ধ: সাহিত্যের প্রাণসত্তা ও সংজ্ঞা
রবীন্দ্রনাথের মতে, সাহিত্যের মর্ম কেবল সংজ্ঞার মধ্যে ধরা যায় না। তিনি একে একটি প্রাণপদার্থের সাথে তুলনা করেছেন। যেমন জীবনের সংজ্ঞা দেওয়া কঠিন, তেমনি সাহিত্যের প্রকৃত স্বরূপও ভাষায় প্রকাশ করা প্রায় অসম্ভব। তিনি বলেন, "যেটুকু সাহিত্যের মর্ম, তাহা সংজ্ঞার মধ্যে ধরা দেয় না। তাহা প্রাণপদার্থের মতো।" সাহিত্য টিকে থাকে কারণ এর মধ্যে একটি অদৃশ্য জীবনশক্তি আছে। এই জীবনশক্তি লেখকের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, বোধ, এবং অনুভূতির গভীরতম কেন্দ্র থেকে উৎসারিত হয়। সাহিত্যিকের অন্তরাত্মা থেকে কলমের মুখে যখন এই প্রাণ নিঃসৃত হয়, তখনই জন্ম নেয় জীবন্ত সাহিত্য। এটি কোনো যান্ত্রিক প্রক্রিয়া নয়, বরং জীবন থেকে জীবনের সংক্রমণ।
সৃজন বনাম নির্মাণ
প্রবন্ধে
রবীন্দ্রনাথ সাহিত্য
সৃষ্টির প্রক্রিয়াকে
'সৃজন' হিসেবে চিহ্নিত
করেছেন, 'নির্মাণ' হিসেবে নয়।
তিনি বলেন,
"সাহিত্যের মধ্যে
সৃজনের ভাব
আছে, নির্মাণের ভাব
নাই।" নির্মাণ একটি
সচেতন এবং
যান্ত্রিক প্রক্রিয়া,
যেখানে একটি
জড় উপাদানকে
নির্দিষ্ট নিয়মে
গড়ে তোলা
হয়। অন্যদিকে,
সৃজন হলো
এক রহস্যময়,
প্রাণময় এবং
আত্মবিস্মৃত প্রক্রিয়া।
সৃজনকালে লেখক
সচেতনভাবে প্রতি
মুহূর্তে নিজেকে
নিয়ন্ত্রিত করেন
না, বরং তার
ভেতরের এক
অপূর্ব শক্তি
যেন জড়
উপাদানের মধ্যে
চেতনা সঞ্চার
করে। এই
প্রক্রিয়ায় সৃষ্ট
চরিত্র বা
বিষয়বস্তু যেন
নিজের জীবন
নিয়ে আপনা-আপনি গড়ে
ওঠে। তিনি
উদাহরণ দিয়ে
বলেন, লেখক তার
নাটকের চরিত্রগুলিকে
বুদ্ধি, ধর্মনীতি বা
কোনো নির্দিষ্ট
অনুভুতি থেকে
নয়, বরং "সমস্ত মানববৃত্তির
দ্বারা বেষ্টিত
জীবনকোষের মধ্য
হইতে" জন্ম দেন।
সৃজনশীলতা এক
অর্থে অচেতন,
কারণ এটি
যান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণের
ঊর্ধ্বে, আবার একই
সাথে সচেতন,
কারণ তা
গভীরতম চেতনার
স্তর থেকে
উৎসারিত।
সাহিত্যের স্থায়িত্ব ও গতি
রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস করেন, সাহিত্য তখনই স্থায়ী হয় যখন তা জীবনের গতির সাথে যুক্ত হয়। তিনি এটিকে একটি ঘূর্ণায়মান চাকার উপমার সাহায্যে বোঝান। যেমন, একটি বৃহৎ ঘূর্ণায়মান চাকার সাথে একটি ছোট চাকা যুক্ত হলে ছোট চাকাটিও সেই বৃহৎ চাকার গতি লাভ করে। একইভাবে, যখন সাহিত্য লেখকের ব্যক্তিগত জীবনচক্রের মধ্য দিয়ে বৃহৎ সংসারচক্রের গতির সাথে যুক্ত হয়, তখনই তা অনন্ত গতি প্রাপ্ত হয়। তিনি বলেন, "এই উপায়ে সাহিত্য বৃহৎ জীবনের অনন্তগতি প্রাপ্ত হয়।" কিছু সাহিত্য হাতে ঠেলে বা ঘোড়া জুড়িয়ে চালানো হয়, অর্থাৎ কৃত্রিমভাবে তৈরি করা হয়, যা স্থায়িত্ব পায় না। কিন্তু যে সাহিত্য জীবনের গভীর কেন্দ্র থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে উৎসারিত হয়, তা "জীবনের চক্রের সহিত বাঁধিয়া" যায় এবং স্থায়ী গতি লাভ করে। এই স্থায়ীত্ব আসে কারণ সাহিত্য জীবনের চিরন্তন সত্যকে ধারণ করে।
অতিচেতন অবস্থা ও সার্বজনীনতা
রবন্ধে
রবীন্দ্রনাথ তার
ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা
তুলে ধরেছেন।
তিনি বলেন,
সাহিত্য রচনার
সময় তিনি
যেন এক
"অতিচেতন অবস্থা"
লাভ করেন।
এই অবস্থায়
তার ভেতরের
আরেকজন সত্তা
তার অধিকাংশ
চেতনাকে অপহরণ
করে কাজ
করে। এই
সত্তা লেখকের
সঞ্চিত সমস্ত
জ্ঞাত ও
অজ্ঞাত অভিজ্ঞতা,
তার বাস্তব
(Real) এবং আদর্শ
(Ideal) সত্তাকে গলিয়ে
লেখার মধ্যে
প্রকাশ করে।
এই সৃষ্টি
কেবল লেখকের
ব্যক্তিগত সম্পদ
থাকে না,
বরং তা
মানবজীবনের সারবিন্দু
হয়ে ওঠে।
রবীন্দ্রনাথ বলেন,
"আমার জীবনের
যাহা সারবিন্দু
তাহা সমস্ত
মানবজীবনের ধন।"
এই কারণে,
লেখকের ব্যক্তিগত
জীবন থেকে
উৎসারিত সাহিত্য
সকল মানুষের
হৃদয়ে প্রবেশ
করতে পারে
এবং চিরন্তন
হয়ে টিকে
থাকে।
উপসংহার
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই প্রবন্ধটি সাহিত্যের প্রকৃতি নিয়ে এক গভীর দার্শনিক আলোচনা। তিনি দেখিয়েছেন, সাহিত্য কেবল ভাষার কারুকাজ নয়, বরং জীবনের এক গভীরতম ও রহস্যময় প্রকাশ। এটি লেখকের অন্তরাত্মা থেকে উৎসারিত হয়, সৃজনের মাধ্যমে আকার পায় এবং জীবনের অনন্ত গতির সাথে যুক্ত হয়ে স্থায়িত্ব লাভ করে। তাই সাহিত্যের সঠিক মর্ম উপলব্ধি করতে হলে এর প্রাণসত্তাকে অনুভব করতে হবে, কেবল সংজ্ঞার গণ্ডিতে আবদ্ধ হলে চলবে না। এই প্রবন্ধের মাধ্যমে তিনি সাহিত্যকে একটি জীবন্ত, গতিশীল এবং সার্বজনীন সত্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
No comments