জিওফ্রে লিচ (Geoffrey Leech): অর্থের সাত রঙ ।। Seven Hues of Meaning- A Leechian Perspective
জিওফ্রে লিচ (Geoffrey Leech): অর্থের সাত রঙ
প্রখ্যাত অর্থবিজ্ঞানী জিওফ্রে লিচ (Geoffrey Leech) ১৯৭৪ সালে প্রকাশিত তাঁর "Semantics" গ্রন্থে অর্থের সাতটি প্রকারভেদ নিয়ে আলোচনা করেন। এই সাত প্রকার অর্থ হলো: ধারণাগত অর্থ, ভাবার্থ, শৈলিগত অর্থ, আনুভূতিক অর্থ, প্রতিফলিত অর্থ, সহাবস্থানগত অর্থ এবং বক্তব্যগত অর্থ । অর্থ বিচার ও বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে এই সাত প্রকার অর্থ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। নিচে এই সাত প্রকার অর্থের পরিচয় তুলে ধরা হলো:
১. ধারণাগত অর্থ (Conceptual/Denotative Meaning):
কোনো শব্দ শোনার সাথে সাথে যে প্রাথমিক বা মূল অর্থটি আমাদের মস্তিষ্কে আসে, তাকে ধারণাগত অর্থ বলে। একে আভিধানিক (Lexical), যৌক্তিক (Logical) বা নির্দেশমূলক (Denotative) অর্থও বলা হয়। এটি ভাষার মৌলিক অর্থ, যার ওপর ভিত্তি করে অন্যান্য অর্থ গড়ে ওঠে। এই অর্থটি ভাষার ধ্বনিতাত্ত্বিক, রূপতাত্ত্বিক ও বাক্যতাত্ত্বিক স্তরের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়।
এই অর্থ বিশ্লেষণের জন্য বৈপরীত্যসূচক নীতি (+/-) ব্যবহার করা হয় । উদাহরণস্বরূপ, 'ছেলে' ও 'মেয়ে' দুটি শব্দকে বিশ্লেষণের জন্য এই চিহ্ন ব্যবহার করা হয় ।
যেমন, পুরুষের ক্ষেত্রে [+ মানুষ + পুরুষ – মহিলা/নারী – প্রাপ্তবয়স্ক (অর্থাৎ অপ্রাপ্তবয়স্ক মানুষ)]।
[মেয়ে + মানুষ – পুরুষ - প্রাপ্তবয়স্ক] (অপ্রাপ্তবয়স্ক)।
ভাষাবিজ্ঞানীরা ধারণাগত অর্থকে ভাষার প্রাণ বলে মনে করেন।
২। ভাবার্থ (Connotative Meaning):
ধারণাগত অর্থের বাইরে কোনো শব্দের সাথে যে অতিরিক্ত তাৎপর্য বা অনুভূতি জড়িয়ে থাকে, তাকে ভাবার্থ বলে। বাস্তব জগতে ব্যবহারের ফলে শব্দের ধারণাগত অর্থের সঙ্গে আরও কিছু বৈশিষ্ট্য যুক্ত হয়ে এই অর্থ তৈরি হয়। এই ধরনের অর্থের যোগাযোগগত মূল্য আছে। যেমন, ইংরেজি শব্দ 'women'-এর ধারণাগত বৈশিষ্ট্য হলো Human - Male + Adult । এর সঙ্গে Emotional, learned, dependable-এর মতো আরও অনেক অর্থ যুক্ত হতে পারে, যা ভাবার্থ তৈরি করে । একইভাবে, বাংলা শব্দ 'যুবক'-এর সঙ্গে 'প্রাণবন্ত' ও 'হঠকারি'র মতো বৈশিষ্ট্য যুক্ত হতে পারে । ভাবার্থের সঙ্গে দৈহিক, মনস্তাত্ত্বিক ও সামাজিক বৈশিষ্ট্য সম্পর্কিত
৩। শৈলিগত অর্থ (Stylistic Meaning):
বক্তা
বা
লেখকের
নিজস্ব
প্রকাশভঙ্গিকে
শৈলি
বলা
হয়,
এবং
এর
মাধ্যমে
যে
অর্থ
প্রকাশ
পায়,
তাই
শৈলিগত
অর্থ।
এই
অর্থ
বক্তার
বয়স,
লিঙ্গ,
সামাজিক
অবস্থান,
শিক্ষা
এবং
পরিস্থিতি
অনুযায়ী
পরিবর্তিত
হয়। একজন শিক্ষিত
ব্যক্তি সাধারণত
মার্জিত, রুচিশীল ও
প্রমিত ভাষা
ব্যবহার করেন
। তিনি
পরিবেশ ও
পরিস্থিতি অনুযায়ী
প্রমিত, আঞ্চলিক বা
অন্য ভাষার
অর্থ ব্যবহার
করতে সক্ষম
। লুইবুকোর
মতে, "Style is the man
himself" বা শৈলি
হলো ব্যক্তিত্বের
প্রকাশ ।
শৈলির মাধ্যমে
একজন ব্যক্তিকে
সহজেই অন্যদের
থেকে আলাদা
করা যায়
।
৪। আনুভূতিক অর্থ (Affective
Meaning)
একটি শব্দের
বিভিন্ন অর্থের
মধ্যে যে
অর্থটি পরিবেশ
ও পরিস্থিতি
অনুযায়ী আবেগ
বা অনুভূতি
প্রকাশ করে,
তাকে আনুভূতিক
অর্থ বলে
। এই
অর্থ বক্তা
বা লেখকের
ব্যবহার ও
অনুভূতিকে নির্দেশ
করে ।
আভিধানিক অর্থের
বাইরে এসব
শব্দের অর্থ
আবেগ দ্বারা
নিয়ন্ত্রিত হয়
। তোষামোদ,
বিদ্রূপ
বা
অতিরিক্ত
প্রশংসা
প্রকাশের
ক্ষেত্রে
ব্যবহৃত
শব্দ
বা
বাক্যাংশ
এই
ধরনের
অর্থের
উদাহরণ। সামাজিক
বিভিন্ন
অনুষঙ্গ
এই
শব্দের
অর্থকে
প্রভাবিত
করে
থাকে।
৫। প্রতিফলিত অর্থ (Reflected Meaning):
একটি শব্দের অর্থকে বিভিন্নভাবে প্রকাশ করাকে প্রতিফলিত অর্থ বলা হয় । এই ধরনের অর্থ কখনও কখনও বিভ্রান্তি তৈরি করতে পারে । যেমন, খ্রিস্টানরা 'The Comforter' এবং 'The Holy Ghost' দুটি শব্দ একই অর্থে ব্যবহার করে । 'Comforter' শব্দটি ইতিবাচক হলেও 'Ghost' শব্দটি নেতিবাচক । তাই, 'The Comforter'-এর পরিবর্তে 'The Holy Ghost' ব্যবহৃত হলে তা প্রতিফলিত অর্থ হবে । আরেকটি উদাহরণ হলো ইংরেজি 'Gender' এবং 'Sex' দুটি শব্দেরই বাংলা অর্থ 'লিঙ্গ'। 'লিঙ্গ' শব্দটি সাধারণত পুরুষবাচকতা ও স্ত্রীবাচকতা নির্দেশ করলেও অনেক সময় এটি যৌনতা অর্থেও প্রকাশিত হয়, যা প্রতিফলিত অর্থের উদাহরণ।
৬। সহাবস্থানগত অর্থ (Collocative Meaning)
বিশেষ বিশেষ শব্দের সাথে অন্য কোনো শব্দ ব্যবহৃত হয়ে যে অর্থ প্রকাশ করে, তাই হলো সহাবস্থানগত অর্থ । বাক্যে ব্যবহৃত সব শব্দ সব শব্দের সাথে বসে না, এর একটি নির্দিষ্ট নিয়ম আছে । যেমন, ইংরেজি ভাষায় 'Handsome' এবং
'Pitty' দুটি শব্দেরই অর্থ সুদর্শন । কিন্তু 'Handsome' যেখানে ব্যবহৃত হয়, 'Pitty' সেখানে ব্যবহৃত হয় না । 'Handsome' ব্যবহৃত
হয় Boy, man, raincoat-এর মতো শব্দের সাথে, আর 'Pitty' ব্যবহৃত হয় Girl, woman, flower, garden-এর মতো শব্দের সাথে । একইভাবে, বাংলায় "ঘরে চাল নেই" বোঝাতে "চাল বাড়ন্ত" বলা হয়। এখানে "বাড়ন্ত" শব্দটি "চাল"-এর সাথে বসে একটি বিশেষ অর্থ প্রকাশ করছে। শব্দের এই ব্যবহার অর্থের উপর নির্ভরশীল।
৭। বক্তব্যগত অর্থ (Thematic Meaning):
বক্তব্যগত অর্থ হলো কথা বলার সময় বক্তা বিভিন্ন কৌশলে ভাষা প্রয়োগের মাধ্যমে যে অর্থ প্রকাশ করেন । বক্তা তার বক্তব্যকে কীভাবে সাজাচ্ছেন বা কোন অংশে জোর দিচ্ছেন, তার ওপর ভিত্তি করে এই অর্থ তৈরি হয়। বাক্যের গঠন বা শব্দের ক্রম পরিবর্তন করে বক্তব্যগত অর্থ বদলানো যায়, যদিও তার ধারণাগত অর্থ একই থাকতে পারে। যেমন:
(১) সেলিম প্রথম পুরস্কার দান করেছেন। (কর্তৃবাচ্য)
(২) প্রথম পুরস্কার সেলিম কর্তৃক দান করা হয়েছে। (কর্মবাচ্য)
দুটি বাক্যের ধারণাগত অর্থ এক হলেও প্রথমটিতে "সেলিম"-এর ওপর এবং দ্বিতীয়টিতে "প্রথম পুরস্কার"-এর ওপর জোর দেওয়া হয়েছে, ফলে তাদের বক্তব্যগত অর্থ ভিন্ন।
জিওফ্রে লিচের এই সাত প্রকার অর্থ প্রমাণ করে যে, শব্দের অর্থ কেবল আভিধানিক সংজ্ঞার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং তা প্রেক্ষিত, অনুভূতি ও ব্যবহারের ওপর গভীরভাবে নির্ভরশীল।
ভাষার সংজ্ঞা দাও। ভাষার মৌলিক বৈশিষ্ট্য ব্যাখ্যা করেঅর্থের অবস্থান আলোচনা করো। |
No comments