Header ads

শব্দে বোনা ভুবন: ভাষার অন্দরমহল- ধ্বনি থেকে অর্থের পথে ।। Language's Inner World - Phoneme to Meaning

শব্দে বোনা ভুবন: ভাষার অন্দরমহল- ধ্বনি থেকে অর্থের পথে

শব্দে বোনা ভুবন: ভাষার অন্দরমহল- ধ্বনি থেকে অর্থের পথে ।। Language's Inner World - Phoneme to Meaning

ভাষার সংজ্ঞা দাও। ভাষার মৌলিক বৈশিষ্ট্য ব্যাখ্যা করে অর্থের অবস্থান আলোচনা করো।

ভাষা মানুষের যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম, যা তাকে অন্য সব প্রাণী থেকে স্বতন্ত্র করেছে। সাধারণভাবে, মানুষ তার মনের ভাব প্রকাশ করার জন্য কণ্ঠ থেকে যে অর্থবোধক ধ্বনি বা ধ্বনি-সমষ্টি উচ্চারণ করে, তাকেই ভাষা (Language) বলে। ভাষার মাধ্যমে মানুষ তার চিন্তা, অনুভূতি এবং অভিজ্ঞতাকে অন্যের কাছে বোধগম্য করে তোলে।

ভাষাবিজ্ঞানীরা বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ভাষার সংজ্ঞা দিয়েছেন।

  • সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়-এর মতে, "মনের ভাব প্রকাশের জন্য বাকযন্ত্রের সাহায্যে উচ্চারিত ধ্বনি দ্বারা নিষ্পন্ন কোন বিশেষ জনসমাজে ব্যবহৃত স্বতন্ত্রভাবে অবস্থিত তথা বাক্যে প্রযুক্ত শব্দ সমষ্টিকে ভাষা বলে।"
  • . মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্‌ বলেছেন, "মনুষ্যজাতি যে ধ্বনি বা ধ্বনিসকল দ্বারা মনের ভাব প্রকাশ করে, তার নাম ভাষা।"
  • . সুকুমার সেন-এর মতে, "মনের ভাব প্রকাশ করার নিমিত্ত বিভিন্ন জাতির বা সমাজের সকল সভ্যের বোধগম্য বাক্যসমূহের সমষ্টিকে সেই জাতির ভাষা বলে।"

এই সংজ্ঞাগুলো থেকে বোঝা যায়, ভাষা কেবল ধ্বনির সমষ্টি নয়, বরং এটি একটি সুসংগঠিত ব্যবস্থা যা একটি নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর মধ্যে ভাব বিনিময়ের জন্য ব্যবহৃত হয়।

ভাষার মৌলিক বৈশিষ্ট্য:

ভাষার কিছু মৌলিক বৈশিষ্ট্য রয়েছে যা একে স্বতন্ত্র করে তুলেছে:

  • সামাজিক সংগঠন: ভাষা কোনো ব্যক্তির একক সৃষ্টি নয়, এটি একটি সামাজিক প্রতিষ্ঠান। সমাজের প্রকৃতি ভাষার প্রকৃতিকে নির্ধারণ করে।
  • অর্থপূর্ণতা: ভাষার মূল ভিত্তি হলো অর্থ। যেকোনো ধ্বনি বা শব্দসমষ্টিকে ভাষা বলা যায় না, যদি না তা অর্থবোধক হয়।
  • ভাব বিনিময়ের মাধ্যম: ভাষা পরস্পরের মধ্যে চিন্তা অনুভূতির আদান-প্রদানের সবচেয়ে কার্যকর মাধ্যম।
  • চিহ্ন বা প্রতীকের বিন্যাস: ভাষা মূলত কিছু ধ্বনি-প্রতীকের একটি সুবিন্যস্ত ব্যবস্থা, যা একটি নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে চলে।
  • চিন্তার বাহন: ভাষা মানুষের চিন্তাশক্তি কল্পনাশক্তিকে বিকশিত করতে সাহায্য করে এবং চিন্তাকে প্রভাবিত করে।
  • সংস্কৃতি সভ্যতা প্রকাশ: ভাষা একটি সমাজের স্বভাব, সভ্যতা, সংস্কৃতিকে ধারণ করে এবং প্রকাশ করে। একটি ভাষার মাধ্যমে সেই সমাজের মানুষের চিন্তা, ইতিহাস মূল্যবোধ বোঝা যায়।
  • পরিবর্তনশীলতা রক্ষণশীলতা: ভাষা সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তিত হয়, আবার একই সাথে তার কিছু ঐতিহ্যগত বৈশিষ্ট্য এবং মৌলিক কাঠামো ধরে রাখে, যা রক্ষণশীলতা হিসেবে পরিচিত।

ভাষার এই বৈশিষ্ট্যগুলো ভাষাকে একটি জীবন্ত, গতিশীল এবং কার্যকরী মাধ্যম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।

ভাষার মৌলিক উপাদান

ভাষার চারটি মৌলিক উপাদান রয়েছে, এগুলো হলো: ধ্বনিমূল, রূপমূল, বাক্য এবং অর্থ। এই উপাদানগুলো একে অপরের সাথে সম্পর্কযুক্ত এবং ভাষা গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

. ধ্বনিমূল (Phoneme):


ধ্বনিমূল হলো ভাষার ক্ষুদ্রতম একক, যার নিজস্ব কোনো অর্থ নেই কিন্তু শব্দের অর্থ পরিবর্তন করতে পারে। এটি কোনো ভাষার অর্থের পার্থক্য সৃষ্টিকারী ধ্বনি। যেমন, 'কাল' 'খাল' শব্দ দুটির মধ্যে // এবং // ধ্বনিমূলের পার্থক্যের কারণে অর্থ বদলে গেছে। বাংলা ভাষায় মোট ৩৬টি ধ্বনিমূল রয়েছে, যার মধ্যে ৭টি স্বরধ্বনিমূল এবং ২৯টি ব্যঞ্জনধ্বনিমূল। ধ্বনির লিখিত রূপকে বর্ণ বলা হয়। বাংলা ভাষায় বর্ণ রয়েছে ৫০টি। এর মধ্যে স্বরবর্ণ ১১টি এবং ব্যঞ্জনবর্ণ ৩৯টি।

. শব্দ বা রূপমূল (Word or Morpheme)

ভাষার ক্ষুদ্রতম অর্থপূর্ণ একক হলো রূপমূল অনেকগুলো ধ্বনি একত্রিত হয়ে যখন একটি অর্থ প্রকাশ করে, তখন তাকে শব্দ বলে। আধুনিক ব্যাকরণে শব্দকে বিশ্লেষণ করলে যে ক্ষুদ্রতম অর্থপূর্ণ একক পাওয়া যায়, তাই রূপমূল। রূপমূল প্রধানত দুই প্রকার:

  • মুক্ত রূপমূল (Free Morpheme): যে রূপমূল স্বাধীনভাবে ভাষায় ব্যবহৃত হতে পারে এবং নিজেই একটি শব্দ হিসেবে কাজ করে। যেমন: বই, কলম, মানুষ ইত্যাদি।
  • বদ্ধ রূপমূল (Bound Morpheme): যে রূপমূল একা ব্যবহৃত হতে পারে না, অন্য রূপমূলের সাথে যুক্ত হয়ে অর্থ প্রকাশ করে। যেমন: 'গুলো' (বইগুলো), 'টি' (লোকটি) ইত্যাদি।

. বাক্য (Sentence):

একাধিক শব্দ বা রূপমূল একত্রিত হয়ে যখন একটি সম্পূর্ণ মনের ভাব প্রকাশ করে, তখন তাকে বাক্য বলে। বাক্য হলো ভাষার বৃহত্তম একক এবং ভাব বিনিময়ের প্রধান মাধ্যম। আমরা কথা বলার সময় মূলত বাক্যই ব্যবহার করি, কোনো বিচ্ছিন্ন শব্দ বা ধ্বনি নয়। প্রথাগত রূপান্তরমূলক ব্যাকরণবিদগণ বাক্যকে ভাষা বর্ণনার প্রধান একক হিসেবে বিবেচনা করেছেন। গঠন এবং অর্থ অনুসারে বাক্যের বিভিন্ন শ্রেণিবিভাগ রয়েছে।

. অর্থ (Meaning)

অর্থ হলো ভাষার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। কোনো বস্তু বা ধারণা সম্পর্কে মানুষের চিন্তাভাবনাই হলো অর্থ। এটি ভাষার প্রাণ, কারণ অর্থহীন ধ্বনি বা শব্দ ভাষার কোনো কাজে আসে না।  ভাষা ব্যবহারের মূল উদ্দেশ্যই হলো অর্থ প্রকাশ করা। ভাষার সার্থকতা নির্ভর করে তার অর্থ প্রকাশের ক্ষমতার ওপর।

অর্থকে প্রধানত দুটি ভাগে ভাগ করা যায়:

  • আভিধানিক অর্থ (Lexical Meaning): অভিধানে কোনো শব্দের যে অর্থ থাকে, তাকে আভিধানিক অর্থ বলে। এটি শব্দের প্রাথমিক বা মূল অর্থ। যেমন, 'হাত' শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো 'অঙ্গবিশেষ'
  • প্রসঙ্গগত অর্থ (Contextual Meaning): পরিবেশ পরিস্থিতি অনুযায়ী কোনো শব্দ বা বাক্যের যে অর্থ প্রকাশিত হয়, তাকে প্রসঙ্গগত অর্থ বলে। যেমন: "এই ব্যাপারে আমার কোনো হাত নেই"এখানে 'হাত' শব্দটি প্রভাব বা ভূমিকা অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। দৈনন্দিন জীবনে আমরা প্রায়শই এই ধরনের অর্থ ব্যবহার করে থাকি। সাহিত্যে, কথোপকথনে বা কোনো বিষয় গোপন করতে এই অর্থ বিশেষভাবে ব্যবহৃত হয়।

সুতরাং, ভাষার এই মৌলিক উপাদানগুলোর মধ্যে অর্থের অবস্থান কেন্দ্রীয় অপরিহার্য ধ্বনি, শব্দ এবং বাক্যএই সবকিছুর মূল লক্ষ্যই হলো অর্থপূর্ণভাবে মনের ভাব প্রকাশ করা। ভাষার অন্যান্য উপাদানগুলো কেবল অর্থ প্রকাশ করার জন্যই একটি কাঠামো তৈরি করে।


জিওফ্রে লিচ (Geoffrey Leech): অর্থের সাত রঙ
Seven Hues of Meaning- A Leechian Perspective


No comments

Theme images by Maliketh. Powered by Blogger.