Header ads

শব্দের জীবন ও বিবর্তন: অর্থ পরিবর্তনের পাঁচ ধারা ।। Five Streams of Semantic Change

শব্দের জীবন ও বিবর্তন: অর্থ পরিবর্তনের পাঁচ ধারা

শব্দের জীবন ও বিবর্তন: অর্থ পরিবর্তনের পাঁচ ধারা ।। Five Streams of Semantic Change


 
ভাষায় ব্যবহৃত শব্দের অর্থসম্ভার স্থির নয়, বরং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এবং ব্যবহারের ফলে শব্দের অর্থের পরিবর্তন ঘটে। শব্দার্থ পরিবর্তনের এই ধারাকে ভাষাবিদরা সাধারণত পাঁচটি প্রধান ভাগে ভাগ করে থাকেন।

 অর্থ পরিবর্তনের পাঁচটি ধারা হলো –

 ১।    অর্থ বিস্তার (Expansion of meaning) .

২।    অর্থ সংঙ্কোচন (Contraction of meaning)

৩।    অর্থ সংশ্লেষ (Transference of meaning)
৪।    অর্থের উন্নতি (Elevation of meaning)
৫।    অর্থের অবনতি (Deterioration of meaning)

১।     অর্থবিস্তার (Expansion of Meaning)

যখন একটি শব্দ তার মূল সীমিত বা সংকীর্ণ অর্থ থেকে আরও ব্যাপক ও বিস্তৃত অর্থে ব্যবহৃত হয়, তখন তাকে অর্থবিস্তার বলে।  অর্থাৎ, শব্দটি পূর্বে যা বোঝাতো, তার চেয়ে বেশি কিছু বোঝাতে শুরু করে। যেমন -

বর্ষ: বর্ষ: সংস্কৃতে 'বর্ষ' শব্দের মূল অর্থ ছিল 'বর্ষাকাল'। কিন্তু কালক্রমে এর অর্থ প্রসারিত হয়ে 'বছর' বা 'বৎসর' বোঝাতে ব্যবহৃত হতে শুরু করে।

গাঙ: মূল অর্থে 'গঙ্গা নদী' হলেও এখন এটি যেকোনো নদীকে বোঝায়।

তেল: আদিতে শুধু 'তিল থেকে জাত স্নেহপদার্থ' বোঝাতো। কিন্তু এখন সরষে, বাদাম, নারিকেল ইত্যাদি যেকোনো শস্য থেকে নিষ্কাশিত স্নেহপদার্থ এমনকি খনিজ পদার্থ (যেমন: কেরোসিন, পেট্রোল) বোঝাতেও 'তেল' শব্দটি ব্যবহৃত হয়।

কালি: পূর্বে কেবল 'কালো রঙের তরল পদার্থ' বোঝাতো। এখন লাল, নীল, সবুজ ইত্যাদি যেকোনো রঙের লেখার তরলকেই কালি বলা হয়।

মীরজাফর: একজন নির্দিষ্ট ব্যক্তির নাম হলেও বর্তমানে এটি যেকোনো বিশ্বাসঘাতককে বোঝাতে ব্যবহৃত হয়। অর্থ বিস্তারের ফলে শব্দের অর্থ এমন হয়।

২।    অর্থসংকোচন (Contraction of Meaning:

এই প্রক্রিয়াটি অর্থ বিস্তারের বিপরীত। যখন কোনো শব্দের ব্যাপক বা সাধারণ অর্থ কালক্রমে একটি বিশেষ বা সংকীর্ণ অর্থে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে, তখন তাকে অর্থ সংকোচন বলে। যেমন - 

অন্ন: এই শব্দের আদি অর্থ ছিল 'যেকোনো প্রকার খাদ্য'। কিন্তু বর্তমানে এর অর্থ সংকুচিত হয়ে কেবল 'ভাত' বোঝায়।

মৃগ: পূর্বে 'মৃগ' বলতে যেকোনো 'পশু' বোঝানো হতো (যেমন: মৃগরাজ বলতে পশুরাজ সিংহকে বোঝায়)। কিন্তু এখন শব্দটি কেবল 'হরিণ' বোঝাতে ব্যবহৃত হয়।

প্রদীপ: সংস্কৃতে 'প্রদীপ' শব্দের অর্থ ছিল যেকোনো ধরনের আলো। কিন্তু বাংলায় এর অর্থ সংকুচিত হয়ে তেল ও সলতের সাহায্যে জ্বালাবার বিশেষ আলো বা বাতিকে বোঝায়।

মন্দির: মূল অর্থে 'যেকোনো গৃহ' বোঝালেও, এখন এটি শুধু 'দেবগৃহ' বোঝাতে ব্যবহৃত হয়।

কবি:  বৈদিকে কবি শব্দের অর্থ ছিলো জ্ঞানী, প্রাজ্ঞ, সংস্কৃতে এর অর্থ হয় কাব্যরচয়িতা।

৩. অর্থ সংক্রম বা অর্থ সংশ্লেষ (Transference of Meaning)

অনেক সময় শব্দের অর্থ এমনভাবে পরিবর্তিত হয় যে, তার মূল অর্থের সঙ্গে বর্তমান অর্থের কোনো যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে যায়। অর্থের এই ধরনের পরিবর্তনকে অর্থ সংক্রম বা রূপান্তর বলে। যেমন -

সন্দেশ: এই শব্দটির মূল অর্থ ছিল 'সংবাদ' বা 'খবর'। প্রাচীনকালে আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে খবর নিয়ে যাওয়ার সময় মিষ্টি নিয়ে যাওয়ার প্রথা ছিল। সেই অনুষঙ্গ থেকে 'সন্দেশ' শব্দের অর্থ দাঁড়ায় 'মিষ্টান্ন', এবং বর্তমানে এটি এক বিশেষ ধরনের মিষ্টান্নকে বোঝায়।

পাত্র: শব্দটির মূল অর্থ ছিল 'পান করার আধার'। পরে এর অর্থ বিস্তার লাভ করে হয় 'যেকোনো আধার'। সেখান থেকে অর্থ সংকুচিত হয়ে দাঁড়ায় 'কন্যাদানের আধার' এবং অবশেষে শব্দটি 'বর' অর্থে ব্যবহৃত হতে শুরু করে।

ঘর্ম: সংস্কৃতে এই শব্দের আদি অর্থ ছিল 'গরম' বা 'উষ্ণতা'। কিন্তু বাংলায় এর অর্থ পরিবর্তিত হয়ে 'ঘাম' হয়েছে।

 ৪. অর্থের উন্নতি বা অর্থোৎকর্ষ (Elevation of Meaning)

যখন কোনো শব্দ তার আদি সাধারণ বা হীন অর্থ ত্যাগ করে উন্নত, প্রশংসনীয় বা উৎকৃষ্ট অর্থ প্রকাশ করে, তখন তাকে অর্থের উন্নতি বা অর্থোৎকর্ষ বলা হয়। যেমন -

মন্দির: এই শব্দটির আদি অর্থ ছিল 'গৃহ' বা 'ঘর'। কিন্তু বর্তমানে শব্দটি 'দেবালয়' বা 'দেবগৃহ'-এর মতো পবিত্র ও উন্নত অর্থ প্রকাশ করে।

সাহস: শব্দটির পুরোনো অর্থ ছিল 'চুরি বা ডাকাতি করার মতো মন্দ কাজ'। কিন্তু এখন এটি 'নির্ভীকতা' বা 'বীরত্ব'-এর মতো একটি ইতিবাচক গুণ বোঝাতে ব্যবহৃত হয়।

অপরূপ: পূর্বে এর অর্থ ছিল 'কুৎসিত রূপ'। কিন্তু এখন শব্দটি 'অনিন্দ্যসুন্দর' বা অত্যন্ত সুন্দর বোঝাতে ব্যবহৃত হয়।

গোস্বামী: মূল অর্থে 'গরুর মালিক' হলেও, বর্তমানে এটি 'বৈষ্ণব গুরু' বা সম্মানসূচক পদবী হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

 ৫. অর্থের অবনতি বা অর্থাপকর্ষ (Deterioration of Meaning)

এই প্রক্রিয়াটি অর্থের উন্নতির বিপরীত। যখন কোনো শব্দ তার পূর্বের উন্নত বা সাধারণ অর্থ হারিয়ে কালক্রমে হীন, নিন্দনীয় বা তুচ্ছ অর্থ প্রকাশ করে, তখন তাকে অর্থের অবনতি বা অর্থাপকর্ষ বলে। যেমন -

মহাজন: এই শব্দের আদি অর্থ ছিল 'মহৎ ব্যক্তি'। কিন্তু এখন এর অর্থ অবনমিত হয়ে 'সুদের ব্যবসায়ী' বা ঋণদাতা বোঝায়।

ঝি: শব্দটির মূল অর্থ ছিল 'কন্যা' বা 'মেয়ে'। কিন্তু বর্তমানে এটি 'পরিচারিকা' বা 'চাকরানি'র মতো হীন অর্থে ব্যবহৃত হয়।

অর্বাচীন: এর আদি অর্থ ছিল 'নবীন' বা 'নতুন'। কিন্তু বর্তমানে এর অর্থ 'মূর্খ' বা 'নির্বোধ'-এ পরিবর্তিত হয়েছে, যা একটি নেতিবাচক অর্থ বহন করে।

ভণ্ড: মূল অর্থে 'যে ধর্মীয় অনুশাসন পালন করে' বোঝালেও, এখন এটি 'প্রতারক' বা 'মিথ্যাচারী' বোঝায়।

 এই পাঁচটি ধারা ভাষাকে গতিশীল রাখে এবং সময়ের সাথে সাথে নতুন নতুন অর্থের জন্ম দেয়।

No comments

Theme images by Maliketh. Powered by Blogger.