Header ads

দর্শন কী ও কেন: এর পরিধি ও আলোচ্য বিষয়সমূহ ।। The Essence of Philosophy: Exploring Its Scope and Core Subjects

 দর্শন বলতে কী বোঝায়? দর্শনের বিষয়বস্তু আলোচনা করো।

 দর্শন কী ও কেন: এর পরিধি ও আলোচ্য বিষয়সমূহ ।। The Essence of Philosophy: Exploring Its Scope and Core Subjects
দর্শন হলো জ্ঞান প্রজ্ঞার প্রতি অনুরাগ। সংস্কৃত 'দৃশ' ধাতু থেকে উদ্ভূত 'দর্শন' শব্দের অর্থ হলো 'দেখা', যা জ্ঞানচক্ষু দিয়ে বস্তুর অন্তর্নিহিত সত্তা বা জগৎ জীবনের প্রকৃত স্বরূপ উপলব্ধিকে বোঝায়। দর্শনের ইংরেজি প্রতিশব্দ 'Philosophy' শব্দটি গ্রিক 'Philos' (অনুরাগ) এবং 'Sophia' (জ্ঞান বা প্রজ্ঞা) থেকে এসেছে- যার অর্থ হলো জ্ঞানের প্রতি অনুরাগ বা প্রজ্ঞাপ্রীতি। যে ব্যক্তি এই অনুরাগের বশবর্তী হয়ে জ্ঞানান্বেষণে ব্রতী হন, তিনিই দার্শনিক।

দর্শন কোনো স্থির বিষয় নয়, বরং এটি একটি গতিশীল বিচার-বিশ্লেষণধর্মী প্রক্রিয়া। মানুষের বিস্ময়, কৌতুহল, সংশয় এবং ব্যবহারিক প্রয়োজন থেকে এর উৎপত্তি হয়েছে। দার্শনিক রেনে দেকার্ত মনে করেন, দর্শন হলো যুক্তির মাধ্যমে যাচাইকৃত মতবাদ, যা অন্ধবিশ্বাস বা কুসংস্কার থেকে ভিন্ন।

 বিখ্যাত দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেল দর্শনকে বিজ্ঞান ধর্মতত্ত্বের মধ্যবর্তী এক 'অনধিকৃত রাজ্য' (No Man's Land)  হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন, যেখানে যুক্তি দিয়ে এসব মৌলিক প্রশ্নের উত্তর খোঁজা হয়। দর্শন এমন মৌলিক প্রশ্নগুলোর যৌক্তিক অনুসন্ধান করে, যা বিজ্ঞান বা ধর্মতত্ত্ব এককভাবে সমাধান করতে পারে না। যেমনআত্মা কী, স্রষ্টার অস্তিত্ব আছে কি না, মানুষের কর্মের স্বাধীনতা আছে কিনা, জ্ঞান কীভাবে অর্জিত হয়? নৈতিকতা কী? জগৎ কেন সৃষ্টি হলো? এইসব প্রশ্নের উত্তরই দর্শনের মূল আলোচনার বিষয়।

 

দর্শনের বিষয়বস্তু (Subject Matter of Philosophy):

দর্শন একটি সর্বাত্মক বিষয় হওয়ায় এর পরিধি অত্যন্ত ব্যাপক বিস্তৃত। মানব অভিজ্ঞতার প্রায় সকল দিকই এর অন্তর্ভুক্ত। আলোচনার সুবিধার্থে দর্শনের বিষয়বস্তুকে প্রধানত পাঁচটি ভাগে ভাগ করা যায়:

. অধিবিদ্যা (Metaphysics): 

অধিবিদ্যা দর্শনের একটি প্রধান শাখা। এটি গ্রিক শব্দ 'Meta' (পর) এবং 'Physics' (পদার্থবিদ্যা) থেকে উদ্ভূত, যার অর্থ পদার্থবিদ্যার পরে যা অবস্থিত। অধিবিদ্যার মূল কাজ হলো বস্তুর বাহ্যিক রূপের আড়ালে থাকা তার প্রকৃত সত্তা নিয়ে আলোচনা করা। এটি বিশ্বজগতের মৌলিক প্রকৃতি এবং বাস্তবতা সম্পর্কিত প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজে। যেমনআত্মা কী, ঈশ্বর আছেন কি নেই, দেশ কাল কী, দেহ মনের সম্পর্ক কী, ইত্যাদি। অধিবিদ্যা আমাদের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগতের বাইরে কোনো কিছুর অস্তিত্ব আছে কি না, সে বিষয়ে গভীর অনুসন্ধান করে। অর্থ্যাৎ ঈশ্বর, আত্মা, জগৎ, দেশ-কাল, কার্যকারণ সম্পর্ক, সৃষ্টি স্রষ্টার সম্পর্ক, আত্মার অমরত্ব ইত্যাদি অধিবিদ্যার মূল আলোচ্য বিষয়।

. জ্ঞানতত্ত্ব (Epistemology): 

জ্ঞানতত্ত্ব দর্শনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা। এর ইংরেজি প্রতিশব্দ 'Epistemology' গ্রিক শব্দ 'Episteme' (জ্ঞান) এবং 'Logos' (বিদ্যা বা বিজ্ঞান) থেকে এসেছে। জ্ঞানতত্ত্ব জ্ঞানের প্রকৃতি, উৎস, সীমাবদ্ধতা, বৈধতা, জ্ঞান অর্জনের পদ্ধতি প্রভৃতি নিয়ে আলোচনা করে। এটি জ্ঞানের বিভিন্ন উপায়, যেমনবুদ্ধিবাদ, অভিজ্ঞতাবাদ, স্বজ্ঞাবাদ এবং বিচারবাদ নিয়ে পর্যালোচনা করে। কোনো কিছুকে 'জ্ঞান' হিসেবে গ্রহণ করার জন্য তার সত্যতা বৈধতার মানদণ্ড কী হওয়া উচিত, তা নিয়ে জ্ঞানতত্ত্ব গভীর বিশ্লেষণ করে।

. মূল্যবিদ্যা (Axiology): 

দর্শনের যে শাখাটি জীবনের মূল্যবোধ আদর্শ নিয়ে আলোচনা করে, তাকে মূল্যবিদ্যা বলা হয়। মানুষের কোন কাজটি ভালো বা মন্দ, কোনটি সুন্দর বা অসুন্দরএইসবের যৌক্তিক বিচার-বিশ্লেষণ করাই এর লক্ষ্য। এর প্রধান উদ্দেশ্য হলো মানবতার কল্যাণ সাধন করা। মূল্যবিদ্যাকে তিনটি উপশাখায় ভাগ করা হয়:

  • নীতিবিদ্যা (Ethics): এটি নৈতিকতা, মঙ্গল, ন্যায়-অন্যায়, উচিত-অনুচিত ইত্যাদি আদর্শ নিয়ে আলোচনা করে।
  • নন্দনতত্ত্ব (Aesthetics): সৌন্দর্য এবং শিল্পের স্বরূপ প্রকৃতি এর আলোচ্য বিষয়।
  • যুক্তিবিদ্যা (Logic): এটি সঠিক বৈধ যুক্তির নিয়মাবলি নিয়ে আলোচনা করে, যা সত্য অনুসন্ধানে সাহায্য করে।

 মূল্যবিদ্যা এই আদর্শগুলো ব্যক্তিগত নাকি বস্তুগত, তাদের সম্পর্ক কী এবং নৈতিক, ধর্মীয় সৌন্দর্যগত মূল্যবোধের মধ্যে সমন্বয় কীভাবে সাধন করা যায়, তা নিয়ে কাজ করে।

 . মনোদর্শন (Philosophy of Mind): 

মনোদর্শন তুলনামূলকভাবে একটি সাম্প্রতিক শাখা। এটি মন বা আত্মার স্বরূপ, দেহ মনের সম্পর্ক, স্বাধীন ইচ্ছা এবং আত্মার অমরত্ব নিয়ে আলোচনা করে। এটি মনের প্রকৃতি, চেতনা এবং মানসিক অবস্থার দার্শনিক দিকগুলো নিয়ে প্রশ্ন তোলে।


. বিশ্বতত্ত্ব (Cosmology): 

বিশ্বতত্ত্ব গ্রিক শব্দ 'Kosmos' থেকে এসেছে, যার অর্থ 'সুশৃঙ্খল বিশ্বজগত' দর্শনের এই শাখাটি আমাদের দৃশ্যমান বিশ্বজগতের মৌলিক উপাদান, যেমনজড়, প্রাণ, দেশ, কাল, বিবর্তন এবং পরিবর্তন নিয়ে আলোচনা করে। এটি মহাবিশ্বের উৎপত্তি গঠন সম্পর্কিত দার্শনিক প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজার চেষ্টা করে।

উপরোক্ত বিষয়গুলো থেকে বোঝা যায়, দর্শন মানব জীবনের প্রতিটি মৌলিক দিক এবং অভিজ্ঞতাকে তার আলোচনার আওতায় নিয়ে আসে। দর্শন কেবল একটি তাত্ত্বিক বিষয় নয়, বরং এটি জগৎ জীবন সম্পর্কিত মৌলিক প্রশ্নাবলির একটি যৌক্তিক, সুশৃঙ্খল সামগ্রিক অনুসন্ধান এটি ultimately এক প্রকার 'জীবন-দর্শন' যা মানুষকে একটি অর্থবহ পরীক্ষিত জীবনযাপনে সহায়তা করে।

No comments

Theme images by Maliketh. Powered by Blogger.