Header ads

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা এবং হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কের উপর প্রভাব ।। Context of Dhaka University's establishment.

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা এবং হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কের উপর প্রভাব 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা এবং হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কের উপর প্রভাব


ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা (১৯২১) অবিভক্ত বাংলার শিক্ষাজগতে এক সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলেছিল। এটি শুধু একটি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল না, বরং তৎকালীন সামাজিক, রাজনৈতিক এবং সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের এক প্রতিচ্ছবি ছিল। এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট, হিন্দু মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতিক্রিয়া এবং শিক্ষার্থীদের তুলনামূলক পরিসংখ্যান এই ঐতিহাসিক ঘটনার বহুমাত্রিক দিকগুলো তুলে ধরে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মূল শেকড় নিহিত ছিল ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ এবং ১৯১১ সালে তা রদের ঘটনায়। লর্ড কার্জন কর্তৃক ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ তৎকালীন বাংলা প্রদেশকে দুটি অংশে বিভক্ত করেছিলপশ্চিমবঙ্গ (হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ) এবং পূর্ববঙ্গ আসাম (মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ, রাজধানী ঢাকা) ব্রিটিশ সরকারের উদ্দেশ্য ছিল প্রশাসনিক সুবিধার পাশাপাশি বাংলার ক্রমবর্ধমান জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে দুর্বল করা এবং মুসলিমদের ব্রিটিশ-অনুগত করে তোলা। এই বিভাজন মুসলিম সমাজে এক নতুন আশার সঞ্চার করেছিল, কারণ তারা একটি নিজস্ব প্রদেশের রাজধানী পেয়েছিল, যা তাদের শিক্ষাগত অর্থনৈতিক উন্নয়নের সুযোগ এনে দিতে পারত।

তবে, হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের তীব্র আন্দোলনের মুখে ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ করা হয়। এই রদ মুসলিম সমাজে গভীর হতাশার জন্ম দেয়। তারা এটিকে তাদের স্বার্থের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবে দেখে। এই হতাশা প্রশমিত করার জন্য এবং মুসলিমদের ক্ষোভ নিবারণের উদ্দেশ্যে ব্রিটিশ সরকার ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দেয়। তৎকালীন ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ ১৯১২ সালের জানুয়ারিতে ঢাকা সফরকালে এই প্রতিশ্রুতি ঘোষণা করেন।

এই বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বপ্নদ্রষ্টা প্রধান কারিগর ছিলেন বাংলার মুসলিম নেতারা। নবাব সলিমুল্লাহ ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার অন্যতম প্রধান প্রবক্তা। তার অক্লান্ত পরিশ্রম মুসলিম সমাজের শিক্ষাগত উন্নয়নের প্রতি তার গভীর অঙ্গীকার এই ধারণাকে বাস্তবে রূপ দিতে সহায়তা করে। এছাড়া, নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী (যিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য বঙ্গীয় আইন পরিষদে প্রস্তাব পেশ করেন), এবং সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী এর মতো মুসলিম নেতারাও ব্রিটিশ সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করে এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তাদের মূল লক্ষ্য ছিল মুসলিম সমাজের শিক্ষাগত পশ্চাদপদতা দূর করা এবং উচ্চশিক্ষার মাধ্যমে তাদের সামাজিক-রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করা। ১৯১৪ সালের প্রথম বিশ্বযুদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়াকে সাময়িকভাবে বিলম্বিত করলেও, মুসলিম নেতৃবৃন্দের অবিরাম প্রচেষ্টা এবং ব্রিটিশ সরকারের প্রতিশ্রুতি ১৯২১ সালের ১লা জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পথ সুগম করে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া বিরোধিতার কারণ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় হিন্দু সম্প্রদায়ের, বিশেষ করে কলকাতা-কেন্দ্রিক ভদ্রলোকদের, প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া ছিল তীব্র বিরোধিতা। এই বিরোধিতা কেবল একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে ছিল না, বরং এর পেছনে গভীরতর আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক স্বার্থ নিহিত ছিল।

. কলকাতা-কেন্দ্রিক প্রভাব হারানোর আশঙ্কা:

কলকাতা ছিল অবিভক্ত বাংলার শিক্ষাগত, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক অর্থনৈতিক কেন্দ্র। বাংলার বুদ্ধিজীবী, জমিদার পেশাজীবী শ্রেণির অধিকাংশই ছিল হিন্দু এবং তারা কলকাতায় কেন্দ্রীভূত ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ঢাকার গুরুত্ব বৃদ্ধি এবং পূর্ব বাংলায় একটি নতুন শিক্ষাকেন্দ্র গড়ে ওঠা কলকাতা-কেন্দ্রিক হিন্দু ভদ্রলোকদের মধ্যে তাদের ঐতিহ্যবাহী প্রভাব হারানোর আশঙ্কা তৈরি করে। তারা ভয় পেয়েছিল যে, এটি কলকাতার শিক্ষাগত সাংস্কৃতিক শ্রেষ্ঠত্বকে চ্যালেঞ্জ করবে এবং তাদের রাজনৈতিক আধিপত্যকে দুর্বল করবে।

. আর্থিক ব্যয় এবং বিদ্যমান প্রতিষ্ঠানের গুরুত্ব:

হিন্দু ভদ্রলোকরা যুক্তি দিয়েছিলেন যে, নতুন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা ছিল অপ্রয়োজনীয়ভাবে ব্যয়বহুল তাদের মতে, এই বিশাল অর্থ ব্যয় না করে কলকাতার বিদ্যমান শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর উন্নতিতে, যেমন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্প্রসারণে, বা মফস্বলের কলেজগুলোর মানোন্নয়নে ব্যয় করা উচিত। তারা মনে করতেন, নতুন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় অর্থ অপচয় হবে এবং শিক্ষার মান বজায় রাখা কঠিন হবে।

. রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে সন্দেহ:

হিন্দু বুদ্ধিজীবী নেতারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে ব্রিটিশ সরকারের "বিভাজন শাসন" নীতির অংশ হিসেবে দেখেছিলেন। তারা মনে করতেন, এটি মুসলিমদের খুশি করার জন্য এবং হিন্দু-মুসলিম ঐক্য ভাঙার উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। তাদের মতে, বঙ্গভঙ্গ রদ করার পর মুসলিমদের ক্ষোভ প্রশমিত করার জন্য এটি একটি রাজনৈতিক ঘুষ। সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, রাসবিহারী ঘোষ এবং বিপিনচন্দ্র পাল এর মতো তৎকালীন প্রভাবশালী হিন্দু নেতা বুদ্ধিজীবীরা এই পরিকল্পনার তীব্র বিরোধিতা করেন। তারা একে "Eastern Bengal University" বা "Macaulay's University" বলে ব্যঙ্গ করতেন, যা মুসলিমদের জন্য একটি পৃথক শিক্ষাব্যবস্থা তৈরি করবে এবং তাদের বৃহত্তর ভারতীয় জাতীয়তাবাদী স্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন করবে।

. শিক্ষার মান নিয়ে উদ্বেগ:

কিছু হিন্দু নেতা নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন। তাদের আশঙ্কা ছিল যে, ব্রিটিশ সরকারের উদ্দেশ্য কেবল একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা, কিন্তু এর শিক্ষার মান কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমকক্ষ হবে না। এই উদ্বেগ আংশিকভাবে তাদের বৃহত্তর রাজনৈতিক বিরোধিতার একটি অংশ ছিল, যা এই প্রকল্পের গ্রহণযোগ্যতা কমাতে চেয়েছিল।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় মুসলিম সমাজের ভূমিকা তাদের প্রত্যাশা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় মুসলিম সমাজের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত ইতিবাচক এবং তারা এটিকে তাদের শিক্ষাগত সামাজিক উন্নতির একটি মাইলফলক হিসেবে দেখেছিল।

শিক্ষাগত উন্নতির প্রতীক: মুসলিম নেতারা এই বিশ্ববিদ্যালয়কে তাদের শিক্ষাগত উন্নতির এবং সামাজিক-রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের প্রতীক হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে শিক্ষাক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকা মুসলিম সমাজের জন্য একটি আধুনিক উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল এক স্বপ্ন। এই বিশ্ববিদ্যালয় তাদের শিক্ষিত হওয়ার এবং প্রশাসনের উচ্চ পদে যোগদান করার সুযোগ করে দেবে বলে তারা আশা করেছিল।

"পূর্ব বাংলার অক্সফোর্ড": মুসলিম নেতারা এই বিশ্ববিদ্যালয়কে "পূর্ব বাংলার অক্সফোর্ড" হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন, যা এর উচ্চশিক্ষার মান এবং সাংস্কৃতিক গুরুত্বের প্রতি তাদের গভীর শ্রদ্ধাবোধের পরিচায়ক ছিল। তারা বিশ্বাস করতেন যে, এটি শুধু একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নয়, বরং একটি সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হবে যা মুসলিম সমাজের আধুনিকীকরণ এবং জ্ঞান বিকাশে নেতৃত্ব দেবে। এই বিশ্ববিদ্যালয় মুসলিম সমাজের আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি করবে এবং তাদের জাতীয় জীবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনে সক্ষম করে তুলবে। নবাব সলিমুল্লাহর মতো নেতারা এটিকে মুসলিম রেঁনেসাঁর প্রতীক হিসেবে দেখতেন।

প্রতিষ্ঠার প্রথম দশকে (১৯২১-১৯৩১) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হিন্দু মুসলিম শিক্ষার্থীর তুলনামূলক পরিসংখ্যান

প্রতিষ্ঠার প্রথম দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হিন্দু মুসলিম শিক্ষার্থীদের ভর্তির ক্ষেত্রে এক মিশ্র চিত্র দেখা যায়। যদিও মুসলিমদের শিক্ষাগত উন্নতিই ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল উদ্দেশ্য, প্রাথমিক বছরগুলোতে হিন্দু শিক্ষার্থীদের সংখ্যাই বেশি ছিল।

শিক্ষার্থী ভর্তির সংখ্যা: বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সময় (১৯২১-২২ শিক্ষাবর্ষে), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট শিক্ষার্থী ছিল ৮৭৭ জন এর মধ্যে, ৩৭৭ জন মুসলিম এবং ৫০০ জন হিন্দু ছিলেন। অর্থাৎ, প্রথম বছরে মুসলিম শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল মোট শিক্ষার্থীর প্রায় ৪৩%, যা পূর্ব বাংলার মুসলিম জনসংখ্যার অনুপাতের তুলনায় কম হলেও, এটি মুসলিমদের মধ্যে উচ্চশিক্ষার প্রতি ক্রমবর্ধমান আগ্রহের ইঙ্গিত দেয়।

বিভিন্ন অনুষদে শিক্ষার্থীদের বিভাজন:

কলা অনুষদ: প্রাথমিক বছরগুলোতে কলা অনুষদেই সবচেয়ে বেশি শিক্ষার্থী ভর্তি হতো, এবং এখানে হিন্দু মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের শিক্ষার্থীরাই ভর্তি হয়েছিল। তবে, মুসলিম শিক্ষার্থীরা ধর্মতত্ত্ব আরবি, ফার্সি' মতো বিষয়গুলোতে বেশি আগ্রহী ছিল, যা তাদের ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপদ্ধতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল।

বিজ্ঞান অনুষদ: বিজ্ঞান অনুষদে প্রাথমিক বছরগুলোতে হিন্দু শিক্ষার্থীদের সংখ্যা মুসলিমদের তুলনায় বেশি ছিল, কারণ তাদের মধ্যে বিজ্ঞান শিক্ষার প্রতি আগ্রহ আর্থ-সামাজিক সক্ষমতা বেশি ছিল।

আইন অনুষদ: আইন অনুষদেও হিন্দু শিক্ষার্থীরা বেশি ছিল, কারণ আইন পেশা হিন্দু ভদ্রলোকদের মধ্যে জনপ্রিয় ছিল এবং এই পেশায় তাদের পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল।

গ্রাম শহর থেকে আগত শিক্ষার্থীর অনুপাত: প্রাথমিক বছরগুলোতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষার্থীই ছিল শহুরে পটভূমি থেকে আগত, বিশেষত ঢাকা এবং আশেপাশের জেলা শহরগুলো থেকে। গ্রামীণ অঞ্চলের মুসলিম শিক্ষার্থীরা, যারা শিক্ষাগত দিক থেকে পিছিয়ে ছিল এবং আর্থিক অসচ্ছলতা ছিল, তারা উচ্চশিক্ষা গ্রহণে তুলনামূলকভাবে কম সুযোগ পেত। তবে, ধীরে ধীরে গ্রামীণ মুসলিমদের মধ্য থেকেও শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসতে শুরু করে, যদিও তাদের সংখ্যা ছিল কম।

শিক্ষাগত আর্থ-সামাজিক কারণ: প্রাথমিক বছরগুলোতে মুসলিম শিক্ষার্থীদের সংখ্যা কম থাকার প্রধান কারণ ছিল শিক্ষাগত সুযোগের অভাব এবং দারিদ্র্য ব্রিটিশ শাসনের শুরুতে মুসলিমরা আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থায় পিছিয়ে পড়েছিল এবং তাদের মধ্যে উচ্চশিক্ষার প্রসার ছিল সীমিত। বেশিরভাগ মুসলিম পরিবারের আর্থিক সক্ষমতা ছিল না তাদের সন্তানদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠানোর। এছাড়া, গ্রামীণ মুসলিম সমাজে প্রচলিত মক্তব-মাদ্রাসাভিত্তিক শিক্ষার বাইরে আধুনিক উচ্চশিক্ষার ধারণা তখনও সেভাবে প্রসার লাভ করেনি। তবে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা এখানে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মুসলিম শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষ বৃত্তি এবং হোস্টেল সুবিধা প্রদান করে শিক্ষাকে আরও সহজলভ্য করতে সচেষ্ট হয়। সময়ের সাথে সাথে, মুসলিম পরিবারের মধ্যে শিক্ষার গুরুত্ব বাড়তে থাকে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের সহায়ক নীতির কারণে মুসলিম শিক্ষার্থীদের সংখ্যা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। ১৯৩০-এর দশকে মুসলিম শিক্ষার্থীদের সংখ্যা হিন্দুদের সাথে প্রায় সমান হয়ে আসে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা এবং হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কের উপর এর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা অবিভক্ত বাংলার শিক্ষা রাজনীতিতে এক গভীর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলেছিল, যা হিন্দু-মুসলিম সম্পর্ককেও প্রভাবিত করে।

মুসলিম সমাজের শিক্ষাগত উন্নয়ন: এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রকৃতপক্ষে মুসলিম সমাজের শিক্ষাগত উন্নয়নে সহায়ক হয়েছিল। এটি মুসলিমদের মধ্যে আধুনিক উচ্চশিক্ষার প্রতি আগ্রহ তৈরি করে এবং তাদের জন্য সরকারি চাকরি বিভিন্ন পেশায় প্রবেশের পথ উন্মুক্ত করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করা অসংখ্য মুসলিম স্নাতক পরবর্তীতে রাজনীতি, প্রশাসন, শিক্ষা সংস্কৃতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন, যা মুসলিম সমাজের ক্ষমতায়নে ব্যাপক অবদান রাখে। এটি পূর্ব বাংলার মুসলিমদের মধ্যে এক নতুন বুদ্ধিজীবী শ্রেণি তৈরি করে।

বিভাজন নাকি ঐক্য?: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা একদিকে মুসলিম সমাজের জন্য আশার আলো নিয়ে এলেও, অন্যদিকে বাংলার রাজনীতিতে হিন্দু মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভেদকে আরও বাড়িয়ে তুলেছিল হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রাথমিক বিরোধিতা মুসলিমদের মধ্যে এই ধারণা দৃঢ় করে যে, হিন্দুরা মুসলিমদের উন্নতির পথে বাধা সৃষ্টি করছে। এটি মুসলিমদের মধ্যে একটি পৃথক রাজনৈতিক পরিচয়ের প্রয়োজনীয়তা আরও জোরালো করে, যা পরবর্তীতে মুসলিম লীগের "দ্বিজাতি তত্ত্ব" এবং পৃথক মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবিকে শক্তিশালী করে। বিশ্ববিদ্যালয়টি মুসলিমদের মধ্যে সচেতনতা আত্মনিয়ন্ত্রণের আকাঙ্ক্ষা তৈরি করলেও, এটি উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে পারস্পরিক অবিশ্বাসকেও বাড়িয়েছিল।

১৯৪৭ সালের দেশভাগ এবং ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে ভূমিকা: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা শেষ পর্যন্ত ১৯৪৭ সালের দেশভাগ এবং ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে প্রতিফলিত হয়েছিল।

দেশভাগ: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উদ্ভূত মুসলিম বুদ্ধিজীবী রাজনৈতিক নেতারা পাকিস্তানের ধারণার সমর্থক ছিলেন। তারা মনে করতেন, একটি পৃথক মুসলিম রাষ্ট্রের অধীনেই পূর্ব বাংলার মুসলিমদের প্রকৃত উন্নতি সম্ভব।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা: তবে, ১৯৪৭ সালের পর যখন পূর্ব পাকিস্তানকে পশ্চিম পাকিস্তানের উপনিবেশিক মনোভাবের শিকার হতে হয়, তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ই ছিল ভাষা আন্দোলন (১৯৫২) এবং পরবর্তীকালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের (১৯৭১) মূল কেন্দ্রবিন্দু। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকরাই ভাষা সাংস্কৃতিক স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে এবং পরবর্তীতে স্বাধীনতার জন্য অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। এটি প্রমাণ করে যে, বিশ্ববিদ্যালয়টি কেবল একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল না, বরং এটি পূর্ব বাংলার জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার এবং জাতীয়তাবাদী চেতনার প্রতীক হয়ে উঠেছিল।

পরিশেষে বলা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা ছিল একটি জটিল ঐতিহাসিক প্রক্রিয়া, যা তৎকালীন বাংলার রাজনৈতিক, সামাজিক শিক্ষাগত বাস্তবতার ফসল। এটি একদিকে মুসলিম সমাজের শিক্ষাগত উন্নয়ন ক্ষমতায়নের পথ খুলে দিলেও, অন্যদিকে হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিভেদ অবিশ্বাসকে গভীর করে তুলেছিল। এর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব কেবল শিক্ষাক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং এটি ১৯৪৭ সালের দেশভাগ এবং ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ঘটনাগুলোতেও এক নির্ণায়ক ভূমিকা পালন করেছিল।

No comments

Theme images by Maliketh. Powered by Blogger.