আবুল মনসুর আহমদের ব্যঙ্গ: 'আয়না'-র নামকরণের সার্থকতা ।। "Ayna": Aptness of the Title
'আয়না' গল্পগ্রন্থের নামকরণের সার্থকতা:
আবুল মনসুর আহমদ (১৮৯৮-১৯৭৯) রচিত ব্যঙ্গ-গল্প সংকলন 'আয়না' (১৯৩৫) বাংলা সাহিত্যের এক অসাধারণ সৃষ্টি যা বাংলা সাহিত্যে এক বিশেষ স্থান দখল করে আছে। 'আয়না' শব্দের আক্ষরিক অর্থ দর্পণ বা আরশি, যা কোনো বস্তুর অবিকল প্রতিচ্ছবি তুলে ধরে। আবুল মনসুর আহমদের 'আয়না' সমাজের অবিকল চিত্র তুলে ধরে। এই গ্রন্থের নামকরণ অত্যন্ত গভীর তাৎপর্যপূর্ণ এবং লেখকের সমাজ-সচেতন মনোভঙ্গির সার্থক প্রতিফলন। এই গ্রন্থে লেখক তৎকালীন বাঙালি মুসলিম সমাজের ধর্মীয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনের নানা অসঙ্গতি, গোঁড়ামি, ভণ্ডামি এবং অন্তঃসারশূন্যতা এবং কায়েমি স্বার্থের কদর্য দিকগুলো অত্যন্ত তীব্র ব্যঙ্গ ও কৌতুকরসের মাধ্যমে দর্পণের মতো নির্ভুলভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন বলেই এর নামকরণ সম্পূর্ণ সার্থক ও যৌক্তিক। গ্রন্থের গল্পগুলোর উপজীব্য বিষয়বস্তু এই নামকরণের যৌক্তিকতাকে প্রতিষ্ঠা করে:
"হুজুর কেবলা” গল্পে তথাকথিত পীর বা 'হুজুর কেবলা'-র ব্যক্তিগত স্বার্থপরতা, আরাম-আয়েশ এবং অলৌকিকতার নামে সাধারণ মানুষের সরলতাকে পুঁজি করে প্রতারণা করার চিত্র দেখানো হয়েছে। এই চরিত্রটি সমাজের সেই ধর্মীয় নেতা বা পীরতন্ত্রের প্রতিচ্ছবি, যারা আধ্যাত্মিকতার আড়ালে ভোগ-বিলাস করেন।
"নায়েবে নবী" গল্পে 'নায়েবে নবী' (নবীর প্রতিনিধি) উপাধিধারী ধর্মীয় নেতার রাজনৈতিক উদ্দেশ্য এবং ক্ষমতার লোভ উন্মোচিত হয়। ধর্মকে ব্যবহার করে কীভাবে একজন ব্যক্তি রাজনৈতিক ক্ষমতা এবং ব্যক্তিগত কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চান তা এই গল্পে তুলে ধরা হয়েছে।
তারা ওয়াজ নসিয়তে সমাজকে বুঝিয়ে দেন ‘নায়েবে-নবী (আলেম)-দের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব
সমাজের, কারণ তারা পেটের চিন্তা থেকে মুক্ত না হলে ইসলামের রওনক বৃদ্ধি করবেন কেমন
করে?’ আবার কোরআন-হাদিসকে তারা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধর জন্য সুবিধামতো ব্যাখ্যা করতেও
দ্বিধা করেন না।
"মুজাহেদিন" গল্পে তুচ্ছ মুষ্টি চাউলের আয় রক্ষার জন্য মাদ্রাসার মৌলবী সাহেব ও নবাগত মওলানা সাহেব মিলে সমাজে যে ফিতনা সৃষ্টি করেন, তা চরম সংকীর্ণতা ও ধর্মান্ধতার উদাহরণ। তারা একটি উন্নয়নমূলক মাইনর স্কুল ধ্বংস করতে 'মযহাবী কলহ' (হানাফী-মোহাম্মদী ঝগড়া) লাগিয়ে দেন। এই কলহ শেষ পর্যন্ত 'জেহাদ' বা ধর্মযুদ্ধে পরিণত হয়ে সমাজের অর্থনীতি, শান্তি ও জীবনহানি ঘটায়। গল্পের এই অংশটি ধর্মব্যবসায়ীদের চক্রান্ত এবং ধর্মীয় গোঁড়ামির আত্মঘাতী ফলকে আয়নার মতো দেখিয়ে দেয়।
"বিদ্রোহী সংঘ" গল্পে তথাকথিত বিপ্লবী এবং বুদ্ধিজীবী শ্রেণির অন্তঃসারশূন্যতা প্রতিফলিত হয়েছে। কথকের বিদ্রোহের মূল কারণ জাতীয় নয়, বরং ব্যক্তিগত অপমান। অন্যদিকে, 'বিদ্রোহী সংঘ'-এর সদস্যরা 'আইন-শৃঙ্খলা' ও 'প্রথা-সংস্কারের দাসত্ব' মুক্তির নামে মূলত নিজেদের সুবিধাবাদকে আশ্রয় করে। চায়ে চিনি না খাওয়ার নতুন প্রথা সৃষ্টি করা, পুলিশের ভয়ে প্রাচীর টপকে পালিয়ে যাওয়া—এই সব ঘটনা প্রমাণ করে যে, তাদের বিপ্লব কেবলই মুখের বুলি; যা সেই সময়ে বাঙালি সমাজের এক শ্রেণির শিক্ষিত যুবকের ভীরুতা ও আদর্শিক দৈন্যকে অবিকল তুলে ধরে।
"লিভরে-কওম" গল্পের প্রধান চরিত্র মৌলবী ইসমাইল সাহেব হলেন এমন এক নেতার প্রতিচ্ছবি, যিনি সমাজের জন্য আত্মত্যাগ নয়, বরং সমাজের সম্পদ আত্মসাৎ করেন। তিনি বারবার নিজের মতাদর্শ পরিবর্তন করেন—প্রথমে হানাফী-নিন্দুক মোহাম্মদী, তারপর গ্রাহক টানতে অসাম্প্রদায়িক, এবং শেষে তহবিলের হিসাব এড়াতে 'আধ্যাত্মিক সাধনার' নামে আত্মগোপন করেন। ইসমাইল সাহেবের এই উত্থান, চাতুর্যপূর্ণ কৌশল (যেমন, 'উদারতার ছদ্মবেশে সাম্প্রদায়িক মতবাদ প্রচার'), এবং চূড়ান্ত কাপুরুষতা—তৎকালীন রাজনৈতিক ও ধর্মীয় নেতৃত্বের এক কদর্য দিককে আয়নার মতো পাঠকের সামনে তুলে ধরে।
"ধর্ম রাজ্য" গল্পটি ধর্মীয় অন্ধত্ব ও অসহিষ্ণুতার চূড়ান্ত পরিণতির প্রতিচ্ছবি। মসজিদের সামনে বাদ্য বাজানোর মতো একটি তুচ্ছ প্রথা নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে গিয়ে হিন্দু-মুসলমান উভয়েই তাদের সমস্ত জাগতিক কাজ (ব্যবসা, খাদ্য সংগ্রহ, সংসার) পরিত্যাগ করে চব্বিশ ঘণ্টা উপাসনায় মগ্ন হয়। এর ফলস্বরূপ, গোটা শহর এক রাতে স্তব্ধ হয়ে যায় এবং অনাহারে সবাই মারা পড়ে। লাট সাহেব ব্যঙ্গ করে সেই লাশের স্তূপের নাম দেন 'ধর্ম-রাজ্য'। এই মর্মান্তিক দৃশ্য দেখায় যে, ধর্মকে জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য বানিয়ে জাগতিক বাস্তবতা ও মানবিক প্রয়োজনকে অস্বীকার করলে একটি সমাজ কীভাবে অনিবার্য ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যায়। এটি তৎকালীন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার আত্মঘাতী ফলকে এক রূপক আয়নায় প্রতিফলিত করেছে।
"গো-দেওতা কা দেশ" গল্পটি একটি রাজনৈতিক-সামাজিক ব্যঙ্গরচনা, যেখানে ধর্মীয় গোঁড়ামি, অসহিষ্ণুতা এবং সাম্প্রদায়িক রাজনীতি কী ভয়াবহ ও হাস্যকর পরিণতি ডেকে আনতে পারে, তা তুলে ধরা হয়েছে একটি উদ্ভট স্বপ্নের মাধ্যমে। গল্পের মূল বক্তব্য হলো: জাতীয় ঐক্যের পথে 'গো-রক্ষা'র মতো সাম্প্রদায়িক ইস্যু টেনে এনে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি হলে তার চূড়ান্ত ফল হয় আত্মধ্বংস এবং দেশ সম্পূর্ণভাবে গো-জাতির দখলে চলে যাওয়া।
একটি আয়না যেমন ব্যবহারকারীকে তার ত্রুটিগুলো দেখিয়ে দেয়, তেমনি এই গল্পগুলি মুসলিম সমাজকে তাদের দুর্বলতাগুলো দেখিয়ে আত্মসমালোচনার পথ উন্মুক্ত করেছে। লেখক এই গল্পগুলোর মাধ্যমে পরোক্ষভাবে এই বার্তা দেন যে, তাদের এই দুরাবস্থার জন্য ইংরেজ বা অন্য কোনো শক্তি নয়, বরং তারা নিজেরাই দায়ী। লেখক হাস্যরস ও ব্যঙ্গকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে পাঠককে তার সমাজের প্রতিবিম্ব দেখতে বাধ্য করেছেন। এই প্রতিফলন দেখে বাঙালি মুসলমান সমাজ যেন তাদের নেতৃত্বের প্রতি আস্থা স্থাপনে সচেতন হয়, ধর্মীয় গোঁড়ামি পরিহার করে যুক্তিবাদী ও প্রগতিশীল হয় এবং নিজেদের ভাগ্য নিজেরাই নিয়ন্ত্রণ করতে শেখে—এটাই ছিল লেখকের মূল আহ্বান।
আবুল মনসুর আহমদ তাঁর 'আয়না' গল্পগ্রন্থের মাধ্যমে সমাজের ভণ্ড, সুবিধাবাদী, এবং আত্মঘাতী শক্তিগুলোকে এক নিস্পৃহ দর্পণের মতো তুলে ধরেছেন। ধর্মীয় ও রাজনৈতিক অন্তঃসারশূন্যতা, কাপুরুষতা ও মূর্খতাকে চরম ব্যঙ্গের মাধ্যমে প্রতিফলিত করার কারণেই এই নামকরণ যুগপৎ সার্থক, অর্থপূর্ণ এবং যথার্থ হয়েছে। এই 'আয়না' কোনো নিছক প্রতিচ্ছবি নয়, বরং এটি সমাজকে পরিবর্তনের দিকে চালিত করার একটি সজাগ প্রয়াস।


No comments