Header ads

অলংকার, ফাতিমা খানম


                                                                              ফাতিমা খানম

বাংলা অলঙ্কারশাস্ত্র মূলত সংস্কৃত অলঙ্কারশাস্ত্রেরই অনুবর্তন। সংস্কৃতে একে সাহিত্যশাস্ত্র বা সাহিত্যতত্ত্ব নামেও অভিহিত করা হয়। ভারতবর্ষে সংস্কৃত অলঙ্কারশাস্ত্রের চর্চা হয়েছে বহুকাল আগে থেকেই। ঋগ্বেদে (খ্রিপূর্ব ২৫০০-৯৫০) উপমা, রূপক, উৎপ্রেক্ষা প্রভৃতি অলঙ্কারের প্রয়োগ পাওয়া যায়, কিন্তু তখন পদ্ধতিগতভাবে অলঙ্কারশাস্ত্রের চর্চা হতো কি-না তা জানা যায় না; এমনকি আলঙ্কারিক অর্থে উপমাদি শব্দের প্রয়োগও দৃষ্টিগোচর হয় না। তবে ঋগ্বেদে ব্যাকরণ আলোচনার সূত্রে ‘উপমান’ বা ‘দৃষ্টান্ত’ অর্থে ‘উপমা’ শব্দের উল্লেখ পাওয়া যায়। বেদোত্তর যুগে যাস্ক, পাণিনি, পতঞ্জলি, ভর্তৃহরি প্রমুখ মূলত ব্যাকরণের নানা বিষয় ব্যাখ্যা করার জন্যই ‘উপমা’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। সুতরাং সে যুগে অলঙ্কারশাস্ত্র ছন্দশাস্ত্রের মতো পৃথক শাস্ত্র হিসেবে গড়ে ওঠে নিঅসাধারণ গ্রন্থ।
নবম শতকের শেষদিকে অলঙ্কার একটি বিশিষ্ট শাস্ত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে এবং সে সময়ের বিখ্যাত আলঙ্কারিক হচ্ছেন রাজশেখর। তিনি তাঁর কাব্যমীমাংসা গ্রন্থে অলঙ্কারশাস্ত্রকে বলেছেন ‘সপ্তম বেদাঙ্গ’; কারণ তিনি দেখিয়েছেন, অলঙ্কার বেদের অর্থনির্ণয়ে সহায়ক। দশ-এগারো শতকের আর একজন বিখ্যাত আলঙ্কারিক হচ্ছেন কুন্তক। তাঁর বক্রোক্তিতত্ত্ব অলঙ্কারের ইতিহাসে এক বিশেষ অবদান। তাঁর গ্রন্থের নাম বক্রোক্তিজীবিত।
এগারো শতকের শেষভাগ থেকে বারো শতকের প্রথমভাগ পর্যন্ত কাব্যতত্ত্ব আলোচনার ক্ষেত্রে স্মরণীয় হচ্ছেন ক্ষেমেন্দ্র, ভোজরাজ, মম্মটভট্ট এবং রুদ্রট। ক্ষেমেন্দ্রের ঔচিত্যবিচারচর্চা, ভোজরাজের সরস্বতীকণ্ঠাভরণ, মম্মটের ক্যাব্যপ্রকাশ এবং রুদ্রটের শৃঙ্গারতিলক এ সময়ের কয়েকটি বিখ্যাত গ্রন্থ। তেরো শতকের আলঙ্কারিকদের মধ্যে প্রধান হচ্ছেন বাগ্ভট্ট (বাগ্ভট্টালঙ্কার), জয়দেব, বিদ্যাধর ও বিদ্যানাথ। চৌদ্দ শতকের আলঙ্কারিকরা হচ্ছেন সিংহভূপাল, ভানুদত্ত ও বিশ্বনাথ কবিরাজ। বিশ্বনাথ কবিরাজের সাহিত্যদর্পণ অলঙ্কারশাস্ত্রের ইতিহাসে একখানা অতুলনীয় গ্রন্থ। এতে বহু শ্রেণিভেদসহ ছয়টি শব্দালঙ্কার ও প্রায় সত্তরটি অর্থালঙ্কারের আলোচনা রয়েছে। ষোল শতকের আলঙ্কারিকদের মধ্যে কবিকর্ণপূর ও অপ্পয়দীক্ষিতের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সতেরো শতকে পন্ডিতরাজ জগন্নাথ (রসগঙ্গাধর) দন্ডী ও বামনের রীতিপ্রস্থানকে অলঙ্কারশাস্ত্রের বিবেচনায় পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করে সাহিত্যালোচনার ধারাকে বদলে দিয়েছেন।
যথোচিত অলঙ্কার যেমন নারীর সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে, তেমনি যথোচিত অলঙ্কার কাব্যেরও সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে। তবে ধ্বনিবাদীদের মতে কেবল অলঙ্কারের ওপরই কাব্যত্ব নির্ভর করে না; অলঙ্কৃত বাক্য যেমন কাব্য হয়, তেমনি অনলঙ্কৃত বাক্যও সার্থক কাব্য হতে পারে। আবার, অলঙ্কার অযথার্থভাবে ব্যবহূত হলেও তা কাব্য হয় না। সুতরাং কাব্যের কাব্যত্ব অলঙ্কার থাকা না-থাকার ওপর নির্ভর করে না; কাব্যত্ব নির্ভরশীল অন্য কিছুর ওপর, অলঙ্কারের অতিরিক্ত কিছুর ওপর। নারীর লাবণ্য যেমন তার অঙ্গসংস্থান বা অলঙ্কারের অতিরিক্ত অন্য কোনো বিষয়, তেমনি কাব্যের কাব্যত্ব শব্দ, অর্থ, অলঙ্কার বা রচনারীতির অতিরিক্ত অন্য কোনো বিষয়। আর সে অতিরিক্ত বিষয়ই হচ্ছে ধ্বনি, অর্থাৎ ‘ধ্বনি’ হচ্ছে ব্যঞ্জনা বা প্রতীয়মান অর্থ। যা বাক্যের বাচ্যার্থের চেয়ে ব্যঙ্গ্যার্থকে প্রধান করে তোলে তা-ই ধ্বনি। এ ধ্বনি তিন প্রকার বস্ত্তধ্বনি, অলঙ্কারধ্বনি ও রসধ্বনি। এগুলির মধ্যে রসধ্বনি প্রধান, কারণ অন্য দু ধ্বনিরও রসেই পর্যবসান হয়। অভিনবগুপ্ত ধ্বনিবাদেরই একজন সমর্থক ছিলেন।বাক্য পাঠ করার সময় তার দুটি দিক পাঠককে আকৃষ্ট করে: ধ্বনি (Sound) ও অর্থ (Sense)। তাই শব্দের ধ্বনিরূপ ও অর্থরূপের সঙ্গে সম্পর্কিত হয়ে প্রধানত দু ধরনের অলঙ্কার সৃষ্টি হয়। ধ্বনিরূপকে অবলম্বন করে যে অলঙ্কার সৃষ্টি হয় তাকে বলা হয় শব্দালঙ্কার, আর তার অর্থকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট অলঙ্কারকে বলা হয় অর্থালঙ্কার।
শব্দালঙ্কার এক্ষেত্রে শব্দ বা ধ্বনি নিয়ামক হিসেবে কাজ করে। শব্দের ধ্বনিরূপের বিপর্যয় ঘটলে শব্দালঙ্কারের কোনো তাৎপর্য থাকে না। যেমন জীবনানন্দ দাশের ‘চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা’ এ পঙক্তিতে ‘র’ ধ্বনির বারবার উচ্চারণের ফলে এক ধরনের ধ্বনিসাম্য সৃষ্টি হয়েছে, যে কারণে কবিতাটি বিশেষ গ্রহণযোগ্যতা লাভ করেছে। একই ধ্বনির এরূপ পুনরাবৃত্তির মাধ্যমেই শব্দালঙ্কারের সৃষ্টি হয়। শব্দালঙ্কারের নানা শ্রেণিবিভাগ রয়েছে; তার মধ্যে প্রধান বিভাগগুলি হচ্ছে: অনুপ্রাস, যমক, বক্রোক্তি, শ্লেষ ও পুনরুক্তবদাভাস।
অর্থালঙ্কার শব্দের অর্থরূপের সাহায্যে যে-সকল অলঙ্কার সৃষ্টি হয় তাকে বলে অর্থালঙ্কার। অর্থালঙ্কারে শব্দধ্বনি গৌণ, তার অর্থই প্রধান। এজন্য অর্থ ঠিক রেখে শব্দ বদলে দিলেও অর্থালঙ্কারের কোনো পরিবর্তন হয় না। সাধারণ লক্ষণ অনুযায়ী অর্থালঙ্কারকে পাঁচভাগে ভাগ করা যায়। সেগুলি হচ্ছে: সাদৃশ্যমূলক, বিরোধমূলক, শৃঙ্খলামূলক, ন্যায়মূলক ও গূঢ়ার্থপ্রতীতিমূলক।
সাদৃশ্যমূলক অলঙ্কার সাধারণত দুটি ভিন্ন ধরনের বিষয় বা বস্ত্তর মধ্যেকার কোনো সাদৃশ্যের ওপর নির্ভর করে সৃষ্টি হয়। যেমন: ‘মেয়েটি দিন দিন লতার মত বেড়ে উঠছে’ এখানে ‘মেয়েটি’ এবং ‘লতা’ দুটি ভিন্নধর্মী পদার্থ হওয়া সত্ত্বেও তাদের মধ্যে গুণগত সাদৃশ্যের কারণে তুলনা করায় সাদৃশ্যমূলক অলঙ্কারের সৃষ্টি হয়েছে। আলঙ্কারিক পরিভাষায় এর নাম উপমা। উপমা, উৎপ্রেক্ষা, রূপক, অতিশয়োক্তি, অপহ্নুতি, সন্দেহ, নিশ্চয়, প্রতিবস্তূপমা, দৃষ্টান্ত, নিদর্শনা, ব্যতিরেক, ভ্রান্তিমান, সমাসোক্তি, প্রতীপ প্রভৃতি সাদৃশ্যমূলক অলঙ্কারের অন্তর্ভুক্ত।
বিরোধমূলক অলঙ্কার সৃষ্টি হয় দুটি পদার্থের আপাত বিরোধকে অবলম্বন করে। যেমন: ‘বড় যদি হতে চাও, ছোট হও তবে’ এখানে আপাত বিবেচনায় ‘বড় হওয়া’ এবং ‘ছোট হওয়া’ এ দুটি বিষয়ের মধ্যে পার্থক্য থাকলেও প্রকৃত কোনো বিরোধ নেই। তাই এটি বিরোধমূলক অলঙ্কারের উদাহরণ। বিরোধমূলক অলঙ্কারের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখ্য হচ্ছে বিরোধাভাস, বিভাবনা, বিশেষোক্তি, অসঙ্গতি ও বিষম অলঙ্কার।
শৃঙ্খলামূলক অলঙ্কার হয় বাক্যগঠনের ক্ষেত্রে বাক্যাংশের শৃঙ্খল।

No comments

Theme images by Maliketh. Powered by Blogger.