উপভাষা ও এর বৈশিষ্ট্য এবং উপভাষা চর্চার ইতিহাস ।। Dialects and their characteristics and history
উপভাষা ও এর বৈশিষ্ট্য এবং উপভাষা চর্চার ইতিহাস
উপভাষা (Dialect): অঞ্চলভেদে ভাষার পার্থক্যকে বলা হয় উপভাষা বা আঞ্চলিক ভাষা। অন্যভাবে বলা হয়, প্রমিত বা মান ভাষার (standard language) পাশাপাশি প্রচলিত অঞ্চল বিশেষে ব্যবহৃত ভাষাকে বলা হয় আঞ্চলিক ভাষা। এই আঞ্চলিক ভাষাই হলো উপভাষা। পৃথিবীর সব ভাষারই এরূপ আঞ্চলিক ভাষা লক্ষ করা যায়। প্রমিত ভাষার সঙ্গে উপভাষার ধ্বনি, রূপমূল, বাক্যগত ও ব্যাকরণগত কাঠামোর মধ্যে পার্থক্য থাকে। উপভাষাই ভাষার প্রাণরূপে পরিগণিত হয়। সাধারণত প্রমিত ভাষা ভৌগোলিক ব্যবধান, সামাজিক ও অর্থনৈতিক পার্থক্যের কারণে উপভাষার সৃষ্টি হয়। প্রমিত ভাষা দেশের সর্বত্র ব্যবহৃত হয়। লিখিত ভাষার ক্ষেত্রে তা অনুসরণ করা হয়ে থাকে। কারণ এ-ভাষা সবাই বোঝে। কিন্তু উপভাষার ব্যবহার কেবল বিশেষ অঞ্চলে জনসাধারণের মধ্যেই সীমিত থাকে।
উপভাষা বলতে প্রমিত ভাষার ব্যতীত আঞ্চলিক রূপকে বোঝায়। একই ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্ভূক্ত কোন একজন ব্যক্তি বা দল এমন ভাষায় কথা বলে যা সে বাকগোষ্ঠীর অন্যান্য লোকদের ভাষা থেকে পৃথক। এরূপ বিশেষ ভাষাকে প্রচলিত অর্থে উপভাষা বলা হয়। ভাষাগোষ্ঠী বলতে বোঝায় যারা একই ভাষায় কথা বলে। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থা, ভৌগোলিক অবস্থান, অর্থনৈতিক বৈষম্য, সামাজিক ও ধর্মীয় কারণে বিভিন্ন উপভাষার সৃষ্টি হয়েছে।
উপভাষা শব্দটি ইংরেজি Dialect শব্দের প্রতিশব্দ এই Dialect শব্দটি ফরাসি শব্দ Dialecte থেকে উৎপত্তি লাভ করেছে। আবার এই Dialecte শব্দটি ল্যাটিন শব্দ Dialectus ও গ্রিক শব্দ Dialecktos থেকে এসেছে। Dialecktos শব্দের অর্থ way of speaking or local language অর্থাৎ আঞ্চলিকতার কারণে যখন ভাষার বৈচিত্র্য দেখা যায় তখন তাকে উপভাষা বলে।
উপভাষার বৈশিষ্ট্য:
১. উপভাষা হলো ভাষার আঞ্চলিক রূপ।
২. ভৌগোলিক বা আঞ্চলিকভাবে উপভাষার বৈশিষ্ট্য নিয়ন্ত্রিত হয়।
৩. আঞ্চীকভাবেই পৃথক বা সামাজিকভাবে পৃথক জনগোষ্ঠী থেকেই উপভাষার আবির্ভাব।
৪. উপভাষার উচ্চারণ ও শব্দভাণ্ডারে বৈচিত্র্য থাকে।
৫. উপভাষা অধ্যয়নের মাধ্যমে কোনো বিশেষ অঞ্চলের মানুষের বৈচিত্র্যপূর্ণ তথ্য পাওয়া যায়।
৬. কোন উপভাষা যখন স্বতন্ত্র্য বেশি হয় এবং তা দেশের মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পায় তখন তা আদর্শ ভাষায় পরিণত হয়।
৭. প্রমিত ভাষার সঙ্গে উপভাষার পার্থক্য ধ্বনি, রূপমূলের উচ্চারণ ও ব্যাকরণগত প্রভৃতি ক্ষেত্রে।
৮. সাধারণত প্রমিত ভাষায় ভাষীর সংখ্যা বৃদ্ধি, ভৌগোলিক ব্যবধান এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক শ্রেণিবিন্যাসের কারণে উপবাষার সৃষ্টি হয়।
৯. প্রমিত ভাষা দেশের সর্বত্র ব্যবহার হয়। কিন্তু উপভাষা কেবল বিশেষ অঞ্চলের জনসাধারণের মধ্যেই সীমিত থাকে।
প্রতিটি ভাষার আঞ্চলিক বৈচিত্র্য আছে। একই ভাষার বিভিন্ন আঞ্চলিক বৈচিত্র্য হলো উপভাষা। এ- আঞ্চলিক বৈচিত্র্য বা উপভাষা নির্ণয়ের জন্য বিভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়। উপভাষাতত্ত্ব হচ্ছে ভাষাবিজ্ঞানের একটি প্রায়োগিক শাখা। এ শাখায় বিভিন্ন অঞ্চলে ব্যবহৃত ভাষার ভাষাতাত্ত্বিক রূপ বৈচিত্র্য আলোচিত হয়ে থাকে। সমাজভাষাবিজ্ঞানের সঙ্গে উপভাষাতত্ত্বের আলোচনার কোনো কোনো অংশের সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়। বর্তমানে উপভাষাতত্ত্বে ভাষার মৌলিক উপাদানগুলি আলোচিত ও বিশ্লেষিত হয়ে থাকে। ভাষাবিজ্ঞানীরা এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, ভাষাার মূল বৈশিষ্ট্য মূলত এই উপভাষার মধ্যে নিহিত থাকে। তাই উপভাষা আলোচনার গুরুত্ব রয়েছে। উপভাষা নিয়ে যে তত্ত্বে আলোচনা করা হয় তাকে বলা হয় উপভাষাতত্ত্ব (Dialectology) ।
উপভাষা চর্চার ইতিহাস:
অতি প্রাচীনকাল থেকেই উপভাষা চর্চা ও বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। প্রাচীনকালে ভাষা আলোচনা, ভাষার পার্থক্য বোঝাতে এই উপভাষার আশ্রয় নেয়া হতো। উপভাষা চর্চায় গুরুত্বপূর্ণ নাম হল জর্জ ওয়েনকার। তিনি জার্মানক এবং ফ্রান্সের ৫০ হাজার স্কুল শিক্ষকের কাছ থেকে একটি প্রশ্নমালা পাঠিয়ে দিলেন । তিনি এই প্রশ্নমালার মাধ্যমে ৪০ টি বাক্যের স্থানীয় রূপ বৈচিত্র্য জানতে চেয়েছিলেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল বিভিন্ন অঞ্চলের শব্দের রূপ সংগ্রহ করা। এরপর ১৮৮১ সালে এসব উপকরণের ভিত্তিতে তিনি এই কাজ শুরু করেন।
১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে ভিয়েনায় অনুষ্ঠিত হয় ওরিয়ান্টাল কংগ্রেসের সভা। এই সভায় ভারতের ভাষা পরিপের প্রস্তাব গৃহিত হয়। হ প্রকল্পের কাজ শুরু হয় ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দে। স্ট্যান্ডার্ড অনুবাদ একটি অঞ্চলে প্রচলিত ভষার নমুনা সংগ্রহ এবং শব্দ বাক্যের তালিকা এই তিনটি উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে প্রকল্পের পরিকল্পনা করা হয় ভাষা জরিপে স্থির করা হয় যে, বিভিন্ন অঞ্চলের ভাষা এর মাধ্যমে সংগ্রহ করা হবে। ২৩১ টি এলাকা ও ৭৩৪ টি প্রাদেশিক ভাষা নির্বাচন করা হয়। ভাষা জরিপে প্রাথমিক তালিকা নমুন সংগ্রহ ও সম্পাদনার উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। এভাবে ভারতীয় অঞ্চলে ভাষা জরিপের কাজ শুরু হয়।
পরবর্তীকালে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত উপভাষা জরিপ ও উপভাষা মানচিত্র নিয়ে একাধিকবার বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন কর হয়। এরপর জুলে, গিলিয়েরন এবং এডমন্ড ভাষাতাত্ত্বিক মানচিত্র নির্মাণ করেন। মোট ১৩ খণ্ডে গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। উপভাষাতত্ত্বের ইতিহাসে এটি একটি যুগান্তকারীর গ্রন্থ। এরপর ভারতীয় ভাষার অনুসন্ধানে জন বিমস্ রচনা করেন "A comparative grammar of he modern Aryan languages in the India" এ গ্রন্থটি ভারতীয় আর্য ভাষার স্তরবিন্যাসে ভূমিকা পালন করেছে। ভারতীয় উপমহাদেশে উপভাষাতত্ত্ব চর্চার ইতিহাসে জর্জ আব্রাহাম গ্রিয়ারসনের নাম উল্লেখযোগ্য। তিনি "Linguistic Survey of India" নামে যে গ্রন্থটি রচনা করেন, তা উপভাষাতত্ত্ব চর্চার ইতিহাসে একটি আকর গ্রন্থ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। ১৯০৩ - ১৯২৫ সালের মধ্যে প্রকাশিত হয়। উপভাষা চর্চা বর্তমানে উইলিয়াম ব্রাইট, উইলিয়াম ম্যাক, বারমাক ভাষাতাত্ত্বিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে উপভাষা চর্চায় অবদান রেখেছেন। তারা Dia-topic survey মাধ্যমে সামাজিক বাা সমাজ পরিস্থিতি অন্বেষণের মধ্য দিয়ে উপভাষার চর্চা করেছেন।
বাংলা ভাষী অঞ্চলে উপভাষা চর্চায় জর্জ আব্রাহাম গ্রিয়ারসনের নাম বিশেষভাবে স্মরণীয় । তবে এর আগেও এ বিষয়ে কিছু দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। বাংলা ভাষার প্রথম ব্যাকরণ রচনাকারী "মনোয়েল দ্যা আসসুম্পসাও" ১৭৩৪ সালে গাহীপুরের ভাওয়াল গড়ে গবেষণা করে ভোকাবুলারিও এম ইদিওমা বেঙ্গলা-ই পর্তুগিজ' নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন। গ্রন্থটি ১৭৪৩ সালে পর্তুগালের রাজধানী লিসবন থেকে প্রকাশিত হয়। এটি ছিল মূলত বাংলা -পর্তুগিজ, পর্তুগিজ- বাংলা অভিধান। গ্রন্থটি বাংলা উপভাষার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। এই গ্রন্থে তিনি বাংলা এবং পর্তুগিজ শব্দ তালিকার মাধ্যমে ভাষা জরিপের কাজটি করেছিলেন। এরপর বাংলা উপভাষা চর্চার ক্ষেত্রে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে উপভাষা চর্চায় ভূমিকা রাখেন। বাংলা উপভাষা চর্চায় ডঃ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ ও সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ডঃ মহাম্মদ শহীদুল্লাহ বাংলা ভাষাকে প্রধান দুটি শাখায় ভাগ করেছেন। (১) প্রাচ্য শাখা, (২) প্রাশ্চাত্য শাখা।
ওয়েনকারের পর ফরাসী উপভাষাবিদ জে. গিলেও ফরাসী উপভাষা সংগ্রহে অগ্রসর হন । ১৯০২-১৯১০ সালে প্রকাশিত হয় উপভাষার মানচিত্র। Atlas Linguistic da la France. এই গ্রন্থের মাধ্যমে ১৯ শতকে উপভাষা চর্চার সূত্রপাত হয়। এই ধারাবাহিকতা পরবর্তীকালে ইংল্যান্ডে উপভাষা চর্চার পথিকৃৎ জোসেফ ব্রাইট, এ.জে এলিস ও ডব্লিউ স্কিট উপভাষার গতিকে আারও ত্বরান্বিত করেন। উপভাষা চর্চাকে বেগবান করার জন্য ১৯৭০ দশকে প্রতিষ্ঠিত হয় English Dialect Society. ১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দে আমেরিকা 'American Dialect Society' প্রতিষ্ঠর পর আমেরিকার বিভিন্ন অঞ্চলে উপভাষা সংগ্রহ মানচিত্র প্রণয়নের কাজ শুরু হয়। এক্ষেত্রে হ্যান্স কোরাট, র্যাাভেন ম্যাক, ডেভিট হ্যারোল্ট, বি এলেন প্রমূখ উপভাষা তাত্ত্বিকের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লহর এ সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ হচ্ছে বাংলা ভাষার আঞ্চলিক ভাষার অভিধান। এ গ্রন্থটি বাংলা উপভাষা চর্চার গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের উপভাষাত্ত্ব সম্পর্কিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হলো The origin and development of Bengali Language (ODML)। এ গ্রন্থে তিনি মধ্যযুগীয় বাংলা থেকে মুরু করে আধুনিক বংলার উপভাষা বিশ্লেষণ করেছেন। এরপর ভাষার ইতিবৃত্ত গ্রন্থে সুকুমার সেন বাংলা উপভাষার শ্রেণীবিন্যাস করেছেন। এরপর কৃষ্ণপদ গোস্বামী, পরেশচন্দ্র মজুমদার প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। ১৯৭৭ খ্রিস্টাব্দে পরেশচন্দ্র মজুমদারের বাংলা ভাষা পরিক্রমা গ্রন্থে আধুনিক বাংলা উপভাষার ধ্বনিতাত্ত্বিক বিশ্লেষিত হয়। এরপর রাজিব হুমায়ূন, আশীষ কুমার দে, শফিকুল ইসলাম প্রমুখ বাংলা উপভাষা চর্চায় অবদান রেখেছেন।
উপভাষ হচ্ছে ভাষার প্রাণ। উপভাষা চর্চার মধ্য দিয়েই ভাষা বৈচিত্র্যের বিভিন্ন দিক আলোচনা করা যায়। কাজেই উপভাষা চর্চার গুরত্ব ও প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
No comments