বাংলা উপভাষার শ্রেণিবিন্যাস ।। Classification of Bengali dialects
বাংলা উপভাষার শ্রেণিবিন্যাস
বাংলা উপভাষার শ্রেণিবিন্যাসের ক্ষেত্রে যে বিষয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ তা হলো বাংলা উপভাষা বিশ্লেষণে বিভিন্ন ব্যক্তির ভূমিকা। বাংলা ভাষার উপভাষা বিশ্লেষণে পথিকৃৎ হলেন পর্তুগিজ ধর্মযাজক মনোয়েল দ্য আসসুম্পসাও। ১৭৪৩ খ্রিস্টাব্দে "ভোকাবুলারিও ইম ইদিওমা বেঙ্গলা-ই পর্তুগিজ" নামে যে বইটি রচনা করেন তাতে গাজীপুরের ভাওয়াল অঞ্চলের উপভাষা ব্যবহৃত হয়েছে। এপর ১৭৩৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি রচনা করেন "কৃপার শাস্ত্রের অর্থভেদ" । গ্রন্থটিতে পূর্ববাংলার উপভাষার নমৃনা আলোচিত হয়েছে। ভারতীয় উপমহাদেশের তথা বাংলাদেশের বাংলা ভাষার আঞ্চলিক বৈচিত্র্য প্রথম সামগ্রিক আলোচনা পাওয়া যায় জর্জ আব্রাহাম গ্রিয়ারসনের "লিঙ্গুইস্টিকস সার্ভে অফ ইন্ডিয়া" গ্রন্থে। এ গ্রন্থে তিনি বাংলা ভাষার উপভাষাগুলিকে দুটি ভাগে ভাগ করেনে- পাশ্চাত্য এবং প্রাচ্য। এই দুই শ্রেণির মধ্য সীমান্ত হিসেবে ব্যবহার করেছেন চব্বিশ পরগনা এবং নদীয়া জেলার পূর্ব সীমান্ত।
এই সীমান্ত ব্রহ্মপুত্র বা যমুনা নদী থেকে রংপুর জেলার পশ্চিম সীমানা পর্যন্ত এবং জলপাইগুড়ির পশ্চিমের সীমান্ত পর্যন্ত বিস্তার লাভ করেছে। গ্রিয়ারসনের পাশ্চাত্য বিভাগের অন্তর্ভুক্ত উপভাষা হচ্ছে 'কেন্দ্রীয় বা স্ট্যান্ডার্ড । দক্ষিণ-পশ্চিম, পশ্চিম এবং উত্তর । পশ্চিম উপভাষার দুটি শাখা তিনি উল্লেখ করেছেন। এ শাখায় খাড়িয়া ভাষা, কোচ এবং বিহারীদের ভাষা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। গ্রিয়ারসন বাংলাদেশের স্ট্যান্ডার্ড ভাষা হিসেবে ঢাকা জেলার উপভাষাকে গ্রহণ করেছেন। তিনি বলেছেন, খাটিঁ পূর্ব-বঙ্গীয় উপভাষা, ব্রহ্মপুত্র-যমুনা'র পশ্চিমে ব্যবহৃত হয় না, ঢাকা থেকে উত্তর বঙ্গের দিকে যমুনা নদী অতিক্রম করে রংপুর এবং তার পূর্ব উত্তরের জেলা সমুহের একটি বৈশিষ্ট্যপূর্ণ উপভাষা ব্যবহৃত হয়। এ উপভাষার তিনি নাম দিয়েছেন রাজবংশী। তিনি আরো মনে করেন, পূর্ব বাংলার প্রকৃত উপভাষা খুলনা এবং যশোর জেলা থেকে বিস্তৃত হয়েছে। এরপর কুমিল্লা, ঢাকা, ময়মনসিংহ, সিলেট পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়েছে। ময়মনসিংহর হাজং উপভাষাকে তিনি 'তিব্বতী-বর্মী' ভাষার মিশ্রণ বলেছেন। পাবর্ত্য চট্টগ্রামের চাকমা উপভাষাকে তিনি দক্ষিণ-পশ্চিম নামে পূর্ব-বঙ্গীয় উপভাষার একটি শাখার মর্যাদা দিয়েছেন। গ্রিয়ারসনের বাংলা উপভাষাসমূহের শেণিবিন্যাস নিম্নরূপে দেখানো যেতে পারে:
১. উত্তরবঙ্গীয় - দিনাজপুর, রাজশাহী ও বগুড়া অঞ্চলে প্রচলিত উপভাষা
২. রাজবংশী - রংপুরের উপভাষা
৩. পূর্ববঙ্গীয় - (ক) ঢাকা, ময়মনসিংহ, ত্রিপুরা, বরিশাল ও সিলেটের উপভাষা
(খ) ফরিগদপুর, যশোর ও খুলনার উপভাষা
৪. দক্ষিণাঞ্চলীয় - চট্টগ্রাম, নোয়াখালী ও চাকমা অঞ্চলের উপভাষা
জর্জ আব্রাহাম গ্রিয়ারসন বাংলা উপভাষার শ্রেণিকরণে প্রধানত ভৌগোলিক অবস্থানকে গুরুত্ব দিয়েছেন। তবে কখনো কখনো তিনি জাতিগত নামও ব্যবহার করেছেন। যেমন- রাজবংশী, হাজং, চাকমা ইত্যাদি উপভাষা।
গ্রিয়ারসনের পরে বাংলা উপভাষা শ্রেণিবিন্যাসে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের নাম উল্লেখযোগ্য। তার গ্রন্থে তিনি প্রাচীন বাংলার চারটি অঞ্চলের নাম অনুসারে বাংলা উপভাষাগুলোকে ৪টি প্রধান শ্রেণিতে বিভক্ত করেছেন। যেমন- রাঢ, পুন্ড্র বা বরেন্দ্র, বঙ্গ এবং কামরূপ।
সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় মনে করেছেন বাংলা ভাষার উদ্ভব হয়েছে মাগধী, প্রকৃত এম মধ্য দিয়ে মাগধী-অপভ্রংশের বিভিন্ন আঞ্চলিক রূপ থেকে অর্থাৎ বাংলা উপভাষা ও বাংলা ভাষার উদ্ভবে আর্য আগমনের পূর্বে এ দেশে প্রচলিত স্থানীয় ভাষার যে প্রভাব রয়েছে সে বিষয় তিনি তুলে ধরেছেন। তিনি কোল, দ্রাবিড় এবং ভোট-চীনা এই তিনটি অনার্য ভাষার উল্লেখ করেছেন।
ডঃ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ বাংলা ভাষার উপভাষা শ্রেণিকরণে গ্রিয়ারসনের পাশ্চাত্য ও প্রাচ্য শ্রেণিকরণ মেনে নিয়েছেন এবং সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় এর শ্রেণিকরণও উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, পাশ্চাত্য বিভাগে প্রাচীন গৌড় ও রাঢ় এবং প্রাচ্য ভাগে বঙ্গ অবস্থিত। শহীদুল্লাহ কামরূপ গোয়ালপাড়া থেকে পূর্ণিয়া পর্যন্ত উপভাষার জন্য বরেন্দ্র নামটি ব্যবহার করেছেন। তিন বাংলা ভাষা উদ্ভব বিষয়ে বলেছেন এ ভাষার উদ্ভব হয়েছে গৌড়ীয়-প্রাকৃতের পরবর্তী স্তর গৌড়ীয় অপব্যংশ থেকে। এ গৌড়ীয় অপভ্রংশই অঞ্চলভেদে বিভিন্ন আঞ্চলিক উপভাষায় পরিণত হয়। অর্থাৎ ড. শহীদুল্লাহ জর্জ গ্রিয়ারসন ও সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের বাংলা উপভাষা শ্রেণিকরণে অনুসন্ধানী হলেও তার আলোচনাও স্বতন্ত্র লক্ষনীয়।
সুকুমারসেন, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের শ্রেনিবিন্যাসকে গুরুত্ব দিয়েছেন। তাঁর মতে, বাংলার প্রধান উপভাষা হলো ৫টি। রাঢ়ি (মধ্য-পশ্চিম বঙ্গের উপভাষা), ঝাড়খন্ডি (দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তের উপভাষা), বরেন্দ্রী (উত্তর বঙ্গের উপভাষা), বাঙালি(পূর্ব ও দক্ষিণ বঙ্গের উপভাষা), কামরূপী (উত্তর পূর্ব বঙ্গের উপভাষা)।
সুকুমার সেনের এ শ্রেণিবিন্যাসে দেখা যায়, এ উপভাষাগুলি কোনো একটি বিশেষ উপভাষা নয়, কতগুলো কথ্য ভাষার সমষ্টি। তিনি মনে করেন রাঢ়ী উপভাষা থেকে আধুনিক চলিত ভাষার উদ্ভব। হুগলি, হাওড়া, বর্ধমান জেলার ২৪ পরগনা অহ্চলকে তিনি এ পর্বে উল্লেখ করেছেন। দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের উপভাষা গুলোকে সুকুমার সেন তিনটি প্রধান ভাগে ভাগ করেছেন।
১। মোদিনীপুরের উত্তর ও উত্তর - পূর্ব দিকের কথ্য ভাষা।
২। দক্ষিণ ও দক্ষিণ পশ্চিমের কথ্য ভাষা।
৩। মোদিনীপুর পশ্চিম প্রান্তের ভাষা এবং ঝাড়খন্ডী ভাষা।
সুকুমার সেনের মতে রাঢ়ী ও বরেন্দ্রী মূলত একই উপভাষা ছিলো। পরবর্তীকালে রাঢ়ী থেকে বরেন্দ্রী বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। চট্টীগ্রামী ভাষাকে সুকুমার সেন বাংলার প্রধান 'বি-ভাষা' বলেছেন। আর চাকমাকে তিনি চট্টগ্রামের ভাষার সঙ্গে সম্পৃক্ত করেছেন। বরেন্দী ও বাঙালির মাঝমাঝিতে রেখেছেন কামরুপী ভাষা। বরেন্দ্রীর সঙ্গে কামরূপীর সম্পকর্ৰ নিকটের সম্পর্ক বলে আখ্যায়িত করেছেন।
বাংলা উপভাষা শ্রেণিবিন্যাসের ক্ষেত্রে পরেশচন্দ্র মজুমদারের 'বাঙলা ভাষা পরিক্রমা' গ্রন্থটি উল্লেখযোগ্য। তিনি মুহম্মদ শহীদুল্লাহর উপভাষা শ্রেণিবিন্যাস সম্পর্কে বলেছেন, এ শ্রেণীকরণ রাষ্ট্রীয় নয়, ভৌগলিক। অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশে এরূপ রাষ্ট্রীয় বা রাজনৈতিক বিভাজন স্বীকৃত নয়। এখানে গুরুত্ব পেয়েছে ভৌগোলিক সীমানা। ড. কমুহাম্মদ শহীদুল্লাহ আঞ্চলিক ভাষার অভিধান গ্রন্থে বাংলা উপভাষাকে শ্রেণীবিন্যাস করেছেন। এ বিষয়ে সে আদর্শ অনুসরণ করে অগ্রসর হয়েছেন পশেরচন্দ্র মজুমদার। প্রাচ্য বা বাঙ্গালী উপভাষাগুলিকে ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ যেভাবে বিন্যস্ত করেছেন, পরেশচন্দ্র মজুমদার তার কিছুটা মেনে নিয়েছেন। পরেশচন্দ্র মজুমদারের বাংলা উপভাষা শ্রেণিবিন্যাসে তবুও স্বাতন্ত্র্য লক্ষ্য করা যায়।
বাংলা উপভাষা শ্রেণিকরণের বিভিন্ন ভাষাবিজ্ঞানী আঞ্চলিক ও ভাষাতাত্ত্বিক মানদণ্ডের ভিত্তিতে উপভাষাগুলোকে শ্রেণীবিন্যাস করেছেন। তাদের এই শ্রেণীবিন্যাসে বাংলা উপভাষার বৈশিষ্ট্য ও আঞ্চলিক বিভাজন লক্ষ করা যায়। বাংলা উপভাষা শ্রেণীবিন্যাসের ক্ষেত্রে এ সম্পর্কে অবগত হওয়া প্রয়োজন্।
No comments