Header ads

সাংগঠনিক বাক্যতত্ত্ব: বণ্টনিক বাক্যবর্ণনাকৌশল

সাংগঠনিক বাক্যতত্ত্ব: বণ্টনিক বাক্যবর্ণনাকৌশল 

ভাষাবিজ্ঞানে যতো সহজে ধ্বনি ও রূপ পর্যবেক্ষণ এবং বিচারবিশ্লেষণ করা যায়, ততো সহজে বাক্যকে করা যায় না। সব মানবভাষাতেই আছে সীমিত সংখ্যক ধ্বনি; - কোনো ভাষাই কোটি কোটি ধ্বনি ব্যবহার করে না; সাধারণত বারো থেকে ষাট্টটি ধ্বনির পুনরাবৃত্তের মাধ্যমে গড়ে ওঠে ভাষা। ধ্বনিমূলের চেয়ে, প্রত্যেক ভাষায়, রূপমূলের সংখ্যা অনেক বেশি, কিন্তু তা অসংখ্য নয়। কিন্তু যে - কোনো মানবভাষায় বাক্য সংখ্যাহীন। যেহেতু বাক্য অসংখ্য, তাই সমস্ত বাক্য কারো পক্ষে উপাত্তরূপে গ্রহণ করে পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব নয়। যা পর্যবেক্ষণ অসম্ভব, তা সাংগঠনিক ভাষাবিজ্ঞানীর আয়ত্তের বাইরে। 

সাংগঠনিক তত্ত্বের মূলে আছে 'প্রতিবেশ', 'বণ্টন' ইত্যাদি বোধ, যা সাংগঠনিক ভাষাবিজ্ঞানীদের বাধ্য করে বাক্যকে রূপমূল, বা রূপমূলের চেয়ে বড়ো কোনো ভাষা-এককের পারস্পরিক বিন্যাস বলে বিবেচনা করতে (দ্র হ্যারিস (১৯৫১), ফ্রিজ (১৯৫২))। সাংগঠনিক ভাষাবিজ্ঞানীরা মনে করেছিলেন যে ধ্বনিমূল-রূপমূলের মতো ভাষায় বাক্যও সংখ্যায় সীমিত। তাই তাঁরা পরিতৃপ্ত রয়েছেন ভাষার বিপুল পরিমাণ বাক্যের অতি তুচ্ছ খণ্ডাংশের রৌপ বর্ণনায় ও বিবরণে।  সাংগঠনিক বাক্যতত্ত্বকে  প্রধানত দুটি ভাগে ভাগ করা যায়: 

(ক) বণ্টনিক বাক্যবর্ণনাকৌশল
(খ) অব্যবহিত-উপাদানকৌশল

বণ্টনিক বাক্যবর্ণনাকৌশল:

বণ্টনিক বাক্যবর্ণনাকৌশলের প্রধান পুরুষ হ্যারিস (দ্র হ্যারিস (১৯৪৬, ১৯৫১), এবং ফ্রিজ (দ্র ফ্রিজ (১৯৫২))। হ্যারিস, রূপমূল ও রূপমূলপরম্পরা'র বণ্টনের সাহায্যে বর্ণনা করেন বাক্য, আর ফ্রিজ বর্ণনা করেন পদ বা বাক্যাংশ এর বণ্টন। হ্যারিস চেয়েছেন বাক্যকে রূপমূলপরম্পরা'র পাশাপাশি বসা একাধিক রূপমূলের বিন্যাসরূপে বর্ণনা করতে। ভাষায় কোন কোন রূপমূলপরম্পরা ব্যবহৃত হয়, তিনি তা আবিষ্কার করতে চেয়েছেন, এবং ওই পরম্পরাকে প্রকাশ করতে চেয়েছেন গাণিতিক সূত্রে। এতে তাঁর প্রধান সহায়ক 'প্রতিকল্পন'। সাংগঠনিক রূপতত্ত্বে 'রূপমূল-শ্রেণী' নির্ণয় করা হয় প্রতিকল্পনের সাহায্যে: যে সমস্ত রূপমূল পরস্পরের বিকল্পে বা বদলে ব্যবহৃত হতে পারে, তাদের বিন্যস্ত করা হয় একটি বিশেষ শ্রেণীতে। অর্থ্যাৎ যে সমস্ত রূপমূলের 'প্রতিবেশ' অভিন্ন, সেগুলো অভিন্ন শ্রেণীভুক্ত। উদাহরণরুপে বলা যায়: 'একটি মেয়ে এলো' বাক্যটিতে 'মেয়ে'র বদলে ব্যবহার করা যায় 'ছেলে', 'তরুণী', 'ছাত্র', 'গাধা' ইত্যাদি শব্দ। এ শব্দগুলো 'একটি ______ এলো' প্রতিবেশে বসতে পারে। তাই 'ছেলে', 'মেয়ে', 'তরুণী', 'ছাত্র', 'গাধা' একই শ্রেণীভুক্ত। 

হ্যারিস শুধু র্রপমূলের বদলে রূপমূল বসিয়ে বাক্যবর্ণনায় উৎসায়ী নন। তিনি লক্ষ্য করেছেন যে অনেক স্থলে একটিমাত্র রূপমূলের ব্যবহার করা সম্ভব অব্যবহিত অনেকগুলো রূপমূল, অর্থাৎ 'রূপমূলপরম্পরা'। যেমন উপরের বাক্যে 'মেয়ে' রূপমূলটির বদলে ব্যবহার করা যায় 'সুন্দর তরুণী', 'ডানাকাটা পরী', তালিমারা ট্রাউজার পরা যুবক' ইত্যাদি রূপমূলপরম্পরা। তিনি রূপমূলপরম্পরা বিন্যাস বর্ণনায় উৎসায়ী। তবে তিনি যাত্রা শুরু করেন রূপমূল থেকে, কেননা রূপমূলই সরলতম সার্থ একক, যা পর্যবেক্ষণ করা যায় সহজে। বাক্যবর্ণনায় হ্যারিসের সহায়ক দু-রকম ভাষা-বস্তু - রূপমূল ও রূপমূল পরম্পরা, এবং এক রকম প্রণালি- প্রতিকল্পন। 
এ প্রণালিতে বাক্যবর্ণনায় দরকার ভাষার সমস্ত রূপমূল শনাক্ত করা ও রূপমূলরাশির ধ্বনিমূলক গঠন নির্ণয় করা। এরপরের কাজ হচ্ছে রূপমূলরাশির 'শ্রেণী' নির্ণয় করা; ""অর্থাৎ নির্ণয় করতে হবে কোন কোন রূপমূল অভিন্ন শ্রেণীভুক্ত। রূপমূল-শ্রেণী নির্ণয়ের জন্যে ব্যবহার করতে হবে, পৌনপুনিকভাবে, প্রতিকল্পন প্রণালি। 
প্রতিকল্পন প্রণালি প্রয়োগের পদ্ধতি তলো: কোনো বাক্যের একটি রূপমূলের স্থানে ব্যবহার করতে হবে এক , বা একাধিক রূপমূল পরম্পরা। যেমন-
'ছেলেটি কাকে ডাকছে?' বাক্যের 'ছেলে' রূপমূলটির প্রতিবেশ হচ্ছে '____টি' , এবং ওই শূন্যস্থানে বা প্রতিবেশে ব্যবহার করা যায় 'ওই মেয়ে দু' রূপমূল পরম্পরা।  কোনো প্রতিবেশে একটি রূপমূলের বদলে অন্য একটি, বা একাধিক রূপমূলের ব্যবহার প্রণালি একটি সাধারণ সূত্র দিয়ে প্রকাশ করা যায়। মনে করা যাক 'অ___আ' প্রতিবেশে "ক" বসতে পারে অর্থ্যাৎ আমাদের কৃত্রিম ভাষায় 'অ ক আ' একটি চমৎকার বাক্য, এবং 'ক'-র স্থানে 'খ' বসলে যদি বাক্যটি দুষ্ট না হয়, তবে বুঝতে হবে 'অ খ আ' ও চমৎকার বাক্য। 'অ___আ' প্রতিবেশে বসতে পারে বলে 'ক' ও 'খ' একই 'প্রতিকল্পন শ্রেণী' বা 'বণ্টন শ্রেণী'র সদস্য। 

হ্যারিসের বাক্যবর্ণনার প্রথম ধাপ হচ্ছে রূপমূলের বদলে রূপমূল ব্যবহার। প্রথম ধাপে, উল্লিখিত প্রাতিকল্পনিক প্রণালিতে, ভাষার রূপমূলপুঞ্জকে বিন্যস্ত করতে হবে বিশেষ বিশেষ শ্র্রেণীতে। ফলে দেখা তেবে রূপমূলের 'শ্রেণী', 'উপ-রূপমূল-শ্রেণী', 'উপ-উপ-রূপমূল-শ্রেণী', উপ-'উপ-উপ-রূপমূল-শ্রেণী', 'উপ-উপ-্রউপ____পমূল-শ্রেণী'। শ্রেণীকরণ এবং  শ্রেণীকরণ এবং  শ্রেণীকরণ  চালাতে হবে যতোক্ষণ না  শ্রেণীকরণের অন্তস্তরে পৌছাই। কয়েকটি উদাহরণের সাহায্যে বিষয়টি বোঝার চেষ্টা করি-
(১ )      ক. আপনার গল্পটি চমৎকার। 
             খ. আপনার ঘরটি চমৎকার।

(১ক, খ)তে একই প্রতিবেশে বসেছে 'গল্প' ও 'ঘর' রূপ দুটি, তাই এরা একই শ্রেণীভুক্ত। কিন্তু আরো অনেক প্রতিবেশ পাওয়া যায়, যেখানে 'গল্প' ও 'ঘর' পরস্পরের বিকল্পে বসতে পারে না। যেমন-

(২)          ক. আমি একটি গল্প লিখেছি।
                খ. আমি একটি ঘর লিখেছি।
(২)                
                গ. আমার ঘরটি ঝড়ে ভেঙে গেছে।
                ঘ. আমার গল্পটি ঝড়ে ভেঙে গেছে।
(২)
                ঙ. আমার গল্পটি ডিটেকটিভ।
                চ. আমার ঘরটি ডিটেকটিভ।
 
(২ক, খ) ও (২ঙ, চ)তে  দেখতে পাই, যে-প্রতিবেশে 'গল্প' বসে, সেখানে 'ঘর' বসে না এবং (২গ, ঘ)তে দেখছি যে-প্রতিবেশে 'ঘর' বসে, সেখানে  'গল্প' বসে না।  
তাই (১, ২) - এ পাচ্ছি রূপমূলের তিনটি 'শ্রেণী': 
(ক) রূপমূল শ্রেণী (১) 'গল্প', 'ঘর' যখন উভয়ে একই প্রতিবেশে বসে, 
(খ) রূপমূল শ্রেণী (২) 'গল্প' ____ যে প্রতিবেশে 'গল্প' বসে, কিন্তু 'ঘর' বসে না,  এবং
(গ) রূপমূল শ্রেণী (৩) 'ঘর'' ____ যে প্রতিবেশে 'ঘর' বসে, কিন্তু 'গল্প'  বসে না। 
এভাবে এ-দুটি রূপমূলকে, অন্যান্য রূপমূলের সাথে প্রতিবেশ বিবেচনা করে, সংখ্যাহীন উপ-শ্রেণীতে বিন্যস্ত করতে হবে। এ শ্রেণীকরণ একটি রূপমূলের সাথে আরেকটি রূপমূলের পার্থক্যকেই বড় করে তোলে, তাদের সাদৃশ্য গোপন করে যায়, এবং বাধা দেয় নির্বিশেষ বা সাধারণ সূত্র রচনায়।
হ্যারিস একই প্রণালিতে একটি রূপমূলের বিকল্পে ব্যবহার করতে চান একাধিক রূপমূল, অর্থ্যাৎ রূপমূলপরম্পরা। রূপমূল শ্রেণী শনাক্তির সময় বিবেচনা করা হয় 'অ___আ' প্রতিবেশে 'ক' এবং 'খ' বসতে পারে কি -না? রূপমূলপরম্পরা-শ্রেণী নির্ণয়ের সময় ওই বিবেচনাকে সম্প্রসারিত করা হয়, এবং দেখা হয় , 'অ____আ' প্রতিবেশে শুধু 'ক' বা 'খ' নয় বরং 'কচ' বা 'কছ' বা 'টঠড' অর্থাৎ একাধিক রূপমূল - বসতে পারে কি-না? যদি এরা সবাই এ প্রতিবেশে ব্যবহৃত হতে পারে, তবে এরা পরস্পর বদলযোগ্য। এমন পরিস্থিতিতে বলা যায় যে এরা এমন এক প্রতিকল্পন-শ্রেণীর সদস্য, যা শুধু রূপমূল-শ্রেণী নয়, বরং এক রূপমূলপরম্পরা-শ্রেণী। এ শ্রেণীর প্রতি সদস্যই রূপমূলপরম্পরা; তা একটি রূপমূলে গঠিত হলেও।
যেমন- 'সে কবিতা ভালোবাসে' বাক্যটিতে 'কবিতা' রূপমূলটির স্থানে ব্যবহার করা সম্ভব 'ফুল', 'মদ', 'চাঁদ', 'বেড়াল' ইত্যাদি একক রূপমূল, এবং এ স্থানে ব্যবহার করা সম্ভব 'লাল গোলাপ', 'সাদা বেড়াল', 'জীবনানন্দের প্রেমের কবিতা', 'শিশিরভেজা দূর্বাঘাসে খালিপায়ে হাটতে' প্রভৃতি রূপমূলপরম্পরা। এ প্রণালিতে যেহেতু যে-কোনো পরম্পরাকে যে-কোনো রূপমূল বা পরম্পরা দ্বারা প্রতিকল্পিত করা সম্ভব, তাই ত্রুটিপূর্ণ প্রতিকল্পনের সম্ভাবনা অসীম। যেমন: 'আমি তোমাকে দেখতে চাই' বাক্যের 'তোমাকে দেখতে' অংশের বদলে ব্যবহার করতে পারি একটি মাত্র রূপমূল 'ভাত', এবং 'ভাত'কে সমতুল্য, ও প্রতিকল্পনযোগ্য একক বলে ধরা হচ্ছে ভুল। এ সম্পর্কে সাবধান থাকা দরকার, কিন্তু কীভাবে সাবধান থাকা যাবে, তার নির্দেশ হ্যারিসে নেই। 

ফ্রিজ-এর(১৯৫২) বাক্যবর্ণনাপ্রণালিও বণ্টন-বা প্রতিবেশ ভিত্তিক। তবে তিনি, রূপমূল নয়, বর্ণনা করেন পদ, বা বাক্যাংশের বিচিত্র বিন্যাস। কিন্তু ফ্রিজ বাক্যের প্রচলিত পদবিভাগ মানেন নি, তার লক্ষ্য বাক্যের রৌপ বর্ণনা। প্রথাগত পদপ্রকরণের বিরুদ্ধে তাঁর প্রধান আপত্তি: পদসমূহ শনাক্ত করা হয়েছে আর্থ মানদণ্ডে, এবং সে মানদণ্ড সুষ্ঠভাবে প্রয়োগ করা হয় নি। 




No comments

Theme images by Maliketh. Powered by Blogger.