Header ads

হাজার বছর ধরে উপন্যাসে মন্তু ও টুনির প্রণয় সম্পর্কের ইতিবৃত্ত

 হাজার বছর ধরে উপন্যাসে মন্তু টুনির প্রণয় সম্পর্কের ইতিবৃত্ত:




বাংলা সাহিত্যের এক অনন্য সাহিত্যকর্ম হাজার বছর ধরে (১৯৬৪) উপন্যাসটির রচয়িতা বাংলা সাহিত্যের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র জহির রায়হান (১৯৩৫-১৯৭২) মূলত চলচ্চিত্রকার হিসাবে তার খ্যাতি থাকলেও লেখক হিসাবেও তিনি সমান প্রতিভার সাক্ষর রেখেছেন। আবহমান বাংলার গ্রামীন জীবনের অতি সুন্দর রূপায়ণ ঘটেছে কালজয়ী এই উপন্যাসটিতে। উপন্যাসটিতে ফুটে উঠেছে গ্রামীন জীবনের আনন্দ-বেদনা, হাসি-কান্না, উত্থান-পতন আর সংগ্রামের চিত্র।

উপন্যাসের কাহিনী আবর্তিত হয়েছে পরীর দীঘিকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা এক গ্রামের একটি বিশেষ পরিবার তথা শিকদার বাড়িতে বসবাসরত পরিবারকে কেন্দ্র করে। বাড়িতে মোট আটঘর লোকের বাস। সব মিলে গোটা বিশেক মানুষের বসবাস বাড়িটিতে। তবে বিকশিত চরিত্র হাতে গোণা। তার মধ্যে অন্যতম হল মকবুল, মন্তু আর টুনি চরিত্র তিনটি। আম্বিয়া চরিত্রটির উল্লেখ বারংবার থাকলেও তাকে তেমন বিকশিত ভাবে উপস্থাপন করা হয়নি। একই সাথে বাড়ির সর্বময় কর্তা হবার খাতিরে মকবুলও দখল করেছে অনেকখানি জায়গা। যদিও মন্তু, টুনি আর আম্বিয়াকে নিয়ে একটি ত্রিভূজ প্রেমের গল্প তৈরি হয়েছে; তবে মন্তু আর টুনিই উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র তথা নায়ক-নায়িকা।

মকবুলের তিন স্ত্রীর মধ্যে সবার ছোট টুনি। গায়ের রং কালো। ছিপছিপে দেহ। আয়ত চোখ। বয়স তার তেরচৌদ্দর মাঝামাঝি। সংসার কাকে বলে সে বোঝে না। সমবয়সী কারো সঙ্গে দেখা হলে সব কিছু ভুলে গিয়ে মনের সুখে গল্প জুড়ে দেয়। আর হাসে। হাসতে হাসতে মেঝেতে গড়াগড়ি দেয় টুনি।

সবার দক্ষিণে যে ঘরটা সবার চেয়ে ছোট, ওটায় থাকে মন্তু। একা মানুষ। বাবা মা ভাইরোন কেউ নেই। বাবাকে হারিয়েছে জন্মের মাসখানেক আগে। মাকে, দশ বছর বয়সে।

লোকে বলে, মন্তু নাকি বড় একগুয়ে আর বদমেজাজী।

টুনি বলে, অমন মাটির মানুষ নাকি জন্মে আর দেখেনি সে।

- আহা অমনটি আর হয় না।

গভীর রাত পর্যন্ত মকবুল ও আমেনার সাথে ধান ভানা শেষে খোলা আকাশের নিচে এসে দাঁড়াতে ঠাণ্ডা বাতাসে দেহটা জুড়িয়ে গেলো টুনির। হঠাৎ মনটা খুশিতে ভরে উঠলো। উঠোন থেকে মন্তুর ঘরের দিকে তাকালো ও। একটা পিদিম জ্বলছে সেখানে। একবার চারপাশে দেখে নিয়ে মন্তুর ঘরের দিকে এগিয়ে গেলো টুনি।

উপন্যাসে মন্তু আর টুনির ঘটনা এভাবেই শুরু। বয়সের পার্থক্য কম হওয়ায় দু’জনের বোঝাপড়াটা খুব বেশি। সামাজিক সম্পর্কে তারা দেবর-ভাবী, কিন্তু তাদের মনের সম্পর্ক্য কী? সেটা তারা নিজেরাও জানে না।

আজকাল রাতের বেলা আমেনার ঘরে শোয় মকবুল। টুনি থাকে পাশের ঘরে। ফাতেমা বাপের বাড়ি যাওয়ায় এখন টুনি একা। রাতের বেলা ইচ্ছেমত যেখানে খুশি ঘুরে বেড়ালেও ধরবার উপায় নেই। রাত জেগে মাছ ধরাটা ইদানীং একটা নেশা হয়ে গেছে ওদের। ঘুঘুটে অন্ধকার রাতে গ্রামের পুকুর থেকে অন্য পুকুরে জাল মেরে বেড়ায় ওরা। বিল থেকে শাপলা তুলে, বিক্রির জন্য নয়, অপ্রয়োজনে। শুধু প্রয়োজনে নয়, অপ্রয়োজনেও কাছাকাছি থাকা।

মানুষ তার প্রিয় মানুষটাকে সব ধরনের বিপদ আপদে আগলে রাখতে চায়। রাতে বিরাতে গাঁয়ের পুকুরে মাছ ধরে বেড়ানো, বিপদ আপদের ভয় থাকে। এতে টুনির ভরসার জায়গা মন্তু, আর মন্তুর জন্য গনু মোল্লার কাছ থেকে তিন আনা পয়সা খরচ করে একটা জোরদার তাবিজ নিয়ে এসে মন্তুর হাতে বেঁধে দেয় সে।

সাপ দেখে ভয় পেয়ে বুকের মধ্যে একরাশ থুতু ছিটিয়ে দেয় মন্তু। পেছনে টুনির দিকে তাকিয়ে বলে, বুকে থুক দাও তাইলে কিছু অইবো না। কোন রকম বিতর্কে না এসে নীরবে ওর কথা মেনে নেয় টুনি।

পরের দিন সকালে মন্তুকে পুকুরঘাটে গোসল করতে দেখে টুনি। হঠাৎ তার নজরে এলো মন্তর পিঠের ওপর একটা লম্বা কাটা দাগ। মনে হলো কিছুক্ষণ আগেই বুঝি কিছুর সঙ্গে লেগে চিরে গেছে পিটটা। এতে অস্থির হয়ে ওঠে টুনি, চোখ জোড়া মুহূর্তে করুণ হয়ে আসে। দরদ ভরা কণ্ঠে সে আস্তে করে বললো, চলো কচু পাতার ক্ষির লাগাইয়া বাইন্দা দি, নইলে পাইকা যাইবো, শেষে কষ্ট পাইবা। এভাবেই তারা একজনের কষ্টে অন্য জন কষ্ট পায়, কিন্তু ভালোবাসা তাদের অব্যক্ত।

টুনির বাপের অসুখের খবরে টুনি বাপের বাড়ি যেতে চাইলে মন্তুকে সে অনুরোধ করে পৌছে দেয়ার জন্য। সেটা সম্ভব না হলেও যাওয়ার সময় সে একটা শাপলা ফুলের মালা রেখে যায় মন্তুর ঘরে । এমনটা করা হয় অবচেতন মনেই যাতে প্রিয় মানুষটি তাকে মনে রাখে, ভুলে না যায়।

তারপর হিরনের বিয়ে ঠিক হলে মন্তু নৌকা নিয়ে টুনিকে আনতে যায়। মন্তুকে দেখে টুনি অনেক খুশি হয়, তার চঞ্চল প্রাণ অস্থির হয়ে উঠে। কিন্তু টুনি কিছুই জিজ্ঞেস করে না, শুধু মুখ টিপে বারবার হাসতে থাকে সে।

মন্তুর মনে হলো কমাসে টুনি অনেক পাল্টে গেছে। ওর দেহ পা আগের থেকে অনেক ভারী হয়ে গেছে আর গায়ের রঙে একটা চিকচিকে আভা জেগে উঠেছে। আগের থেকে অনেক সুন্দর হয়েছে টুনি।

রাতে টুনির ঘরে ওর শোবার বন্দোবস্ত হলো। কিছুক্ষণের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়লো মন্তু।

ঘুম ভাঙলো কখন সে ঠিক বলতে পারবে না। রাতের গভীর অন্ধকারে সে অনুভব করলো একটা হাত তার চুলগুলো নিয়ে খেলছে। প্রথমে ভয় পেয়ে গেলো মন্তু। গনু মোল্লার কাছ থেকে নেয়া তাবিজটা বাহুতে বাধা আছে কিনা দেখলো। তারপরে কে যেন চাপা স্বরে ওকে ডাকলো, এই। সহসা কোন সাড়া দিলো না মন্তু।

হঠাৎ ওর হাতখানা শক্ত মুঠোর মধ্যে চেপে ধরলো সে। নরম তুলতুলে একখানা হাত।

একটা অস্পষ্ট কাতরোক্তি শোনা গেল, উঃ এই।

পরমুহূর্তে হাতখানা ছেড়ে দিলো মন্তু। টুনি?

- ইস, কথা কয়ো না। মায় হুনব। ওর মুখের ওপরে একখানা হাত রাখলো টুনি। তারপর মুখখানা আরো নামিয়ে আস্তে আস্তে করে বলো, চুপ, শব্দ কইর না। শোন, চুপচাপ উইঠা আইও আমার সঙ্গে।

কিছু বুঝে উঠতে পারলো না মন্তু। টুনির মুখের দিকে অবাক হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো ও। তারপর ধীরে ধীরে উঠে বসলো সে। একটু পরে টুনির পিছু পিছু বাইরে বেরিয়ে এলো মন্তু।

বাইরে এসে দেখলো টুনির হাতে একটা মাটির কলস। শীতে দুজনে রীতিমত কাপছিলো ওরা।

মন্তু প্রশ্ন করলো, কি, কি অইছে?

টুনি ফিক করে হেসে দিয়ে বললো, কিছু অয় নাই, এদিকে আইও। ওর একখানা হাত ধরে অন্ধকারে টেনে নিয়ে চললো তাকে। বার বাড়িতে এসে মন্তু আবার প্রশ্ন করলো, কই চললা।

টুনি শব্দ করে হাসলো আবার, বললো, কলসি গলায় দিয়া দুইজনে পুকুরে ডুইবা মরুম চল। তার পরেই মন্তুর দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে সহসা প্রশ্ন করল সে, আমার সঙ্গে মরতা পারবা না?

কি উত্তর দিবে ভেবে পেলো না মন্তু। টুনি ঠাট্টা করে বললেও এই মরা কোন মরা, পাঠকের তা বুঝতে না পারার কথা না।

খেজুরগাছ থেকে রস নামিয়ে কলসি ভর্তি করলো ওরা। শীতের রাতে কুয়াশার বৃষ্টি ঝরছে চারদিকে। মাটি ভিজে গেছে। গাছের পাতাগুলোও ভেজা। আশেপাশে তাকাতে গেলে বেশি দূরে দেখা যায় না। কুয়াশার আবরণে ঢেকে আছে চারদিক। হঠাৎ মন্তোর গায়ে হাত দিয়ে টুনি বললো, শীত লাগছে বুঝি? মন্তু কোন জবাব না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করলো, তোমার লাগে না?

টুনি বললো, উঁহু। বলে মাথাটা দোলাল সে।

মন্তু বললো, রস দিয়া করবা কি?

টুনি বললো, সিন্নি রান্দুম।

মন্তু কোন কথা বলার আগেই টুনি আবার বললো, তোমার নায়ে চল।

মন্তু অবাক হলো, নায়ে গিয়া কি করবা?

টুনি নির্লিপ্ত গলায় বললো, সিন্নি রান্দুম।

মন্তু বললো, পাগল হইছ?

টুনি ফিক করে হেসে দিয়ে বললো, হুঁ। বলে মন্তুর মুখের দিকে তাকালো সে, কই নাওয়ে যাইবা না?

মন্তু কঠিন স্বরে বললো, না।

ওর কণ্ঠস্বরে চমকে উঠলো টুনি। ওর চোখের দিকে কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। মুহূর্তে একটা অবাক কাণ্ড করে বসলো সে। হাতের কলসিটা উপরে তুলে মাটিতে ছুঁড়ে মারলো। মাটিতে পড়ে মাটির কলসি ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে গেলো।

রস গড়িয়ে পড়লো চারপাশে।

কিছুক্ষণের জন্য দুজনে বোবা হয়ে গেলো ওরা।

কারো মুখ দিয়ে একটা কথাও বেরুলো না।

মন্তু নীরবে তাকিয়ে রইলো, ভাঙ্গা কলসির টুকরোগুলোর দিকে। টুনি মুখখানা অন্যদিকে ফিরিয়ে নিয়ে অন্ধকারে পাথরের মত নিশ্চল দাড়িয়ে রয়েছে। পুকুর পাড়ে লম্বা তালগাছগুলোর মাথায় দুটো বাদুড় হঠাৎ পাখা ঝাঁপটিয়ে উঠলো।

টুনি আস্তে করে বললে, চল ঘরে যাই, চল।

মন্তু কোন কথা বললো না। নিঃশব্দে একে অনুসরণ করলো শুধু।

 সারাদিন একবারও কাছে এলো না টুনি। অথচ সারাক্ষণ বাড়িতে ছিল সে।

রাতে খাওয়ার সময়ও শারীরিক অসুস্থতার অজুহাত দিয়ে ঘরে গিয়ে শুয়ে থেকেছে সে।

এভাবে মান-অভিমান করে পরের দিন সকাল বেলাই চলে যাওয়ার জন্য সব কিছু গুছিয়ে নিল টুনি।

ভোর বেলাই রওনা হল তারা। নৌকার ছই-এর মধ্যে টুনির জন্যে বিছানা বিছিয়ে দিয়েছিলো মন্তু। তার ওপর গুটিমুটি হয়ে বসলো সে।

তারপর মুখখানা ঘুরিয়ে এনে নীরবে বসে রইলো।

খাল পেরিয়ে যখন নৌকা নদীতে এসে পড়লো তখন দুপুর হয়ে আসছে।

টুনি এতক্ষণ একটা কথাও বলে নি। মন্তু সারাক্ষণ কথা বলার জন্য অ্যাঁকুপাকু করছিলো। কিন্তু একবার সুযোগ দিলো না টুনি। উজান নদীতে দাঁড় বেয়ে চলতে চলতে এক সময়ে মন্তু বললো, বাইরে আইয়া বহো, গায়ে বাতাস লাগবে।

নড়েচড়ে বসলো কিন্তু বাইরে বেরিয়ে এলো না।

একটু পরে একটা কাপড়ের পুটলি থেকে কিছু চিড়া আর এক টুকরো খেজুরের গুড় বের করে এর দিকে এগিয়ে দিলো টুনি। বললো, বেলা অইয়া গেছে-খাইয়া নাও। বলে আবার চুপ করে গেলো সে।

মন্তু বললো, তুমি খাইবা না?

- না।

- না কেন?

- ক্ষিধা নাই।

- ঠিক আছে আমারও ক্ষিধা নাই। বলে আবার দাঁড় বাইতে লাগলো মন্তু। নদীর পানিতে দাঁড়ের ছপ ছপ শব্দ ছাড়া আর কিছুই শোনা গেলো না। ক্ষণকাল পরে টুনি আবার বললো, খাইবা না।

- না।

- শেষে শরীর খারাপ করবো।

- করুক গা। নির্লিপ্ত গলায় জবাব দিলো মন্তু।

আর বেশিক্ষণ ছইয়ের ভেতর বসে থাকতে পারলো না টুনি। অবশেষে বাইরে বেরিয়ে এলো সে, চিড়ার বাসনটা তুলে নিয়ে ওর সামনে এসে বসলো।

- নাও, খাও।

- কইলাম তো খামু না।

- তাইলে কিন্তু পানির মধ্যে সব ফালাইয়া দিমু আমি। টুনি ভয় দেখালো ওকে।

মন্তু নির্বিকার গলায় বললো, দাও ফালাইয়া।

কিন্তু ফেললো না টুনি। কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে থেকে সহসা শব্দ করে হেসে উঠলো সে। হাসির দমকে মাথার ঘোমটাটা খসে পড়লো কাঁধের ওপর।

টুনি বললো, আমি খাওয়াইয়া দিই।

মন্তু বললো, না।

টুনি বললো, তাহলে তুমি নিজ হাতে খাও। আমিও খাই। বলে এক মুঠো চিড়ে মুখের মধ্যে পুরে দিলো সে।

মন্তুর মুখেও এক ঝলক হাসি জেগে উঠলো। এতক্ষণে টুনির কোলের ওপরে রাখা বাসন থেকে এক মুঠো চিড়ে নিয়ে সেও মুখে পুরলো।

টুনি বললো, গুড় নাও। খাজুরি গুড়।

চিড়ে খেতে খেতে কিছুক্ষণের মধ্যে আবার সহজ হয়ে এলো টুনি।

এক ফাঁকে ওকে জিজ্ঞেস করলো, বাড়ি পৌঁছাইতে কতক্ষণ লাগবো?

মন্তু একটু চিন্তা করে নিয়ে বললো, মাইজ রাতে।

বেশ জোরে দাঁড় বাইছিলো মন্তু।

সেই হঠাৎ টুনি বললো, এত তাড়াতাড়ি করছো কেন? আস্তে বাও না।

মন্তু বললো, তাইলে বাড়ি যাইতে তিনদিন লাগবো।

লাগে তো লাগুক না। টুনির কণ্ঠরে চরম নির্লিপ্ততা।

মন্তু কোন জবাব দিলো না।

আঁজলা ভরে নদীর পানি পান করলো ওরা। তারপর ছইয়ের বাইরে বসে টুনি দুহাতে নদীর পানি নিয়ে খেলা করতে লাগলো। দুপাশে অসংখ্য গ্রাম। একটার পর একটা ছাড়িয়ে যাচ্ছে ওরা। মাঝে মাঝে রবি-শস্যের ক্ষেত, নারকেল আর ঘন সুপারির বন। জেলেদের পাড়া।।

 বিকেলের দিকে শান্তির হাটে এসে পৌছলো ওরা।

টুনি পানি থেকে হাতটা তুলে নিয়ে অপূর্ব ভঙ্গী করে বললো, ওইহানে চুড়ি পাওন যায়?

আমারে কিননা দিবা?

মন্তু সংক্ষেপে বললো, হুঁ দিমু।

তারপর সাকার্স দেখার সময়ে বাঘ এসে যখন হুঙ্কার ছাড়লো তখন মন্তুর একখানা হাত ওর মুঠোর মধ্যে শক্ত করে ধরে রাখলো টুনি। দুচোখে ওর অপরিসীম বিস্ময়। ইতিমধ্যে ভয়ে গুটিসুটি হয়ে মন্তুর বুকের মধ্যে সিঁধিয়ে গেছে টুনি। মন্তু নিজেও জানে না কখন টুনিকে একেবারে কাছে টেনে নিয়েছে সে। সার্কাস শেষ হতে দুজনের চমক ভাঙলো। শক্ত করে ধরে রাখা মন্তুর হাতখানা মুহূর্তে ছেড়ে দিলো টুনি। তারপর মাথা নিচু করে নীরবে দাঁড়িয়ে রইলো সে। মন্তু নিজেও কিছুক্ষণের জন্য হতবুদ্ধি হয়ে পড়লো। ইতস্তত করে বললো, চলো।

 

শান্তির হাটের মনোয়ার হাজী টুনিকে মন্তুর স্ত্রী ভেবে ভাবী বলে সম্মোধন করলে এক বিচিত্র অনুভূতির আবেশ অনুভব করে মন্তু। মনোয়ার হাজী যখন বলে, আরে মিয়া নতুন বউ নিয়া যদি একটু ফুর্তি না কইরলা তাইলে চলে কেমন কইরা। এইতো বয়স তোমাগো।

তখন শীতেও ঘামতে থাকে মন্তু। টুনির দিকে তাকিয়ে সে বুঝতে পারলো ভীষণ বিব্রত বোধ করছে। তবে সেখানে অন্যরকম ভালোলাগা ও বেদনার মিশ্রিত অনুভূতি ছিল। সেটা বুঝতে পারি যখন দেখি, নৌকায় ওঠার জন্য নিচে নামতে গিয়ে অন্ধকারে মন্তুর ফতুয়াটার একটি কোণ শক্ত করে ধরে রেখেছে টুনি। একটু অসতর্ক হতে পা পিছলে পড়ে যাচ্ছিলো সে। মন্তু ধরে ফেললো। মাথার অ্যাঁচলটা কাঁধের উপরে গড়িয়ে পড়লো, একটা অস্ফুট কাতরোক্তি করলো টুনি। কাঁধের উপর থেকে ওর মুখখানা সরিয়ে দিতে গিয়ে মন্তু সহসা অনুভব করলো, টুনির দুচোখ বেয়ে পানি ঝরছে। নিঃশব্দে কাঁদছে টুনি! এই নিঃশব্দ কান্না, নিঃশব্দ ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ। এই কান্না মন্তুকে এত কাছে পেয়েও আপন করে না পাওয়ার। একই অবস্থা মন্তুরও। ভাটি গাঙে নাও ভাসিয়ে দিয়ে বসে রইলো মন্তু। মনটা আজ ভীষণ ভেঙ্গে পড়েছে ওর। সারা দেহে আশ্চর্য এক অবসাদ। সেদিন রাতে রসের কলসটা ভেঙ্গে ফেললো টুনি তখনও এত খারাপ লাগে নি ওর। আজ কেমন ব্যথা অনুভব করছে সে। বুকের নিচটায়। কলজের মধ্যে।

 নৌকোর ছইয়ের ভেতরে চুপচাপ বসে রয়েছে টুনি। একটা কথা বলছে না সে, একটু হাসছে না।

হঠাৎ গলা ছেড়ে গান ধরলে মন্তু।

বন্ধুরে আশা ছিলো মনে মনে প্রেম করিমু তোমার সনে।
তোমারে নিয়া ঘর বাঁধিমু গহিন বালুর চরে।
পরাণের বন্ধুয়ারে।

টুনিকে নিয়ে মনে মনে ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখতো মন্তু। তাইতেো হঠাৎ নিজের অজান্তে একটা কথা বলে বসলো মন্তু। বললো, বাড়ি যামু না। এইহানে থাকুম আমরা।

নৌকায় করে বাড়ি ফেরার সেই রাতে একই নৌকায় পাশাপাশি দুটি প্রাণের আবেগ, অভিমান, আদরমাখা আরো বেশ কিছু দৃশ্য দেখতে পাই। যেমন- শীতে কষ্ট হবে দেখে ছইয়ের ভেতর আদরমাখা অভিমানে মন্তুকে টুনির আহ্বান, পরম যত্নে মন্তুর গায়ে কাথা টেনে দেয়া প্রভৃতি।

 

মনের ঘরে যার বসবাস তাকে ঘিরে যখন অন্য কারো আলোচনা চলে সেটা মেনে নেওয়া খুব কঠিন। এমনি ঘটনা দেখতে পাই হিরনের বিয়ের পূর্বমুহূর্তে আম্বিয়া যখন মন্তুর ঘরে গিয়ে খিল দেয়। সবাই মন্তু ও আম্বিয়াকে জড়িয়ে হাসি তামাসা শুরু করলে সেটা মেনে নিতে পারে না টুনি। ফুলে ফুসে ওঠে সে। টুনির কণ্ঠস্বরে চমকে উঠলো সবাই।

তীব্র গলায় সে বললো, কি অইতাছে অ্যাঁ। কি অইতাছে। কাম কজি ফালাইয়া কি শুরু করছ তোমরা। অ্যাঁ?

সহসা সবাই চুপ করে গেলো। একে অন্যের মুখের দিকে তাকাতে লাগলো ওরা। মন্তু নির্বাক।

 তারপর একজন দুজন করে যে যার ঘরে চলে যেতে লাগলো। মন্তু সবে তার ঝাঁপিটা বন্ধ করে দেবে এমন সময় বাইরে থেকে ধাক্কা দিল টুনি। কিছু বলার আগে ভেতরে এসে ঢুকলো সে। পান খেয়ে ঠোঁটজোড়া লাল করে এসেছে। মুখে একটা প্রসন্ন হাসি, হাতে মেহেদী। সঙ্গে একটা মাটির বাটিতে করে আরো কিছু মেহেদী এনেছে সে।

বাটিটা মাটিতে নামিয়ে রেখে টুনি আস্তে করে বললে, দেহি, তোমার হাত দেহি।

মন্তু বললো, ক্যান?

টুনি বললো, তোমারে মেহেদী দিমু।

মন্তু বললো, না।

টুনি বললো, না ক্যান, বলে ওর হাতটা টেনে নিলো সে। মাটিতে বসে ধীরে ধীরে ওর হাতে মেহেদী পরিয়ে দিতে লাগলো টুনি। মন্তু কোন বাধা দিলো না। নীরবে বসে শুধু তাকে লক্ষ্য করে মৃদু হাসলো। কিছুক্ষণ পরে টুনি আবার বললো, আমার একটা কথা রাইখবা?

- কি?

- একটা বিয়া কর।

- হুঁ।

দুজনের আবার চুপ করে গেলো ওরা।

ওর দুহাতের তালুতে সুন্দর করে মেহেদী পরিয়ে দিতে দিতে টুনি আবার বললো, আরেক কথা রাইখবা?

- কি?

- আমার পছন্দ ছাড়া বিয়া কইরবা না।

- হুঁ।

একবার ওর মুখের দিকে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিলো মন্তু। টুনি পরক্ষণে ওর হাতটা কোলের ওপরে টেনে নিয়ে ছোট একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো, কথা দিলা? বলে অদ্ভুতভাবে এর দিকে তাকালো টুনি। মন্তু কি বলবে ভেবে পেলো না। বার কয়েক ঢোক গিললো সে।

 

মন্তু টুনির হৃদয়ে এতটাই জুড়ে আছে যে, সে বুড়ো স্বামীর মৃত্যু কামনায় বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেনি। মকবুল অসুস্থ হলে মন্তু যখন কবিরাজ থেকে ওষুধ নিয়ে আসে তখন টুনির মন্তব্য-

- কি অইবো ওষুধ খাইয়া, বুড়া মরুক।

তারপর অল্প একটু তেঁতুল মুখে পুরে দিয়ে গভীর তৃপ্তির সঙ্গে তার স্বাদ গ্রহণ করতে থাকে সে।

টুনি বললো, কবিরাজ কি কইছে?

মন্তু জবাব দিলো, কইছে, কিছু না, ভালো অইয়া যাইবো।

ভালো অইয়া যাইবোর কথা শুনে চোখজোড়া কপালে তুললো টুনি। এ কথায় খুশি হতে পারলো না সে। রাগ মেটাতে দাওয়া থেকে পিঁড়ি তুলে আশেপাশে ঘোরাফেরা করা নেড়ী কুকুরটার গায়ে ছুঁড়ে মারলো টুনি।

 

গ্রামে ওলা বিবির আগমনের খবরে সবাই অস্থির হয়ে পড়েন। টুনির অস্থিরতা যতটা না নিজের জন্য তারচেয়ে বেশি মন্তুর জন্য। মন্তু কাজ থেকে ফিরে কাঁধের উপর থেকে কুড়োলটা মাটিতে নামিয়ে রাখতে না রাখতে টুনি একপাশে টেনে নিয়ে গেলো ওকে।

- মাঝি-বাড়ি যাও নাই তো?

- মন্তু ঘাড় নাড়লো না, ক্যান কি অইছে।

টুনি বললো, ওলা বিবি আইছে ওইহানে। বলতে গিয়ে মুখখানা শুকিয়ে গেলো ওর।

মন্তুর দুচোখে বিস্ময়। বললো, কার কাছ থাইকা শুনছ?

কথার কোন জবাব না দিয়ে টুনি আবার বললো, শোন, ওই বাড়ির দিকে গেলে কিন্তু আমার মাথা খাও।

তারপর করুন অনুরোধ,

- যাইও না ক্যাম?

মন্তু সায় দিয়ে মাথা নাড়লো কিন্তু বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে উঠতে পারলো না সে।

 

ওলা বিবির কারনে গ্রামের অনেকে মারা গেছেন। সবার কবর খোঁড়ার কাজ করেছেন মন্তু। সবার দাফন শেষে মায়ের কবরের পাশে বসে থাকলো সে। শুকনো পাতার শব্দে পেছনে ফিরে তাকালো মন্তু। টুনি দাঁড়িয়ে পেছনে। সারাদিন ওর দেখা না পেয়ে অনেক খোজের পর এখানে এসেছে সে। মন্তুকে ওর মায়ের কবরের পাশে বসে থাকতে দেখে কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে রইলো টুনি।

তারপর ওর কাঁধের ওপর একখানা হাত রেখে আস্তে করে বললো, ঘরে যাইবা চল।

কোন কথা না বলে নীরবে উঠে দাঁড়ালো মন্তু।

রাতে ঘুম হলো না মন্তুর।

সারাক্ষণ বিছানায় ফটফট করলো সে। না, একটা বিয়ে ওকে এবার করতেই হবে। এমনি একা জীবন কতদিন কাটাবে মন্তু। কিন্তু বিয়ের কথা ভাবতে গেলে ইদানীং টুনি ছাড়া অন্য কোন মেয়ের কথা ভাবতে পারে না সে। শান্তির হাটের সেই রাত্রির পর থেকে টুনি তার সমস্ত অন্তর জুড়ে বসে আছে। গ্রামের কত লোক তাদের বউকে তালাক দেয়। বুড়ো মকবুল কেন তালাক দেয় না টুনিকে।

হঠাৎ পরীবানুর পুঁথির কথা মনে পড়লো মন্তুর।

কুলাটিয়া গ্রামের এক গৃহস্থের বউ পরীবানু। স্বামীর সঙ্গে মিলমিশ হতো না। অষ্টপ্রহর ঝগড়া বিবাদ লেগে থাকতো। ঘর ছেড়ে পুকুর পাড়ে গিয়ে নীরবে বসে থাকতো সে। আর সেখান থেকে দেখতে একটি রাখাল ছেলেকে। দূরে একটা বট গাছের নিচে বসে এক মনে বাঁশি বাজাতো সে। এমনি চোখের দেখায় প্রেম হয়ে গেলো।

তারপর

তারপর একদিন সময় বুঝিয়া।
দুইজনে পালায়া গেলো চোখে ধূলা দিয়া।

মন্তুর তাই মনে হলো। টুনিকে নিয়ে যদি একদিন পালিয়ে যায় সে। দূরে বহুদূরে, দূরের কোন গ্রামে কিম্বা শহরে। না শান্তির হাটে যদি ওকে নিয়ে যায় সে, তা হলে মনোয়ার হাজী নিশ্চয় একটা বন্দোবস্ত করে দেবে। সেখানে টুনিকে নিয়ে সংসার পাতবে মন্তু। যেকোন দোকানে হাজীকে দিয়ে একটা চাকুরি জুটিয়ে নেবে সে।

এমনি আরো অনেক চিন্তা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়লো মন্তু।

 

মন্তুর প্রতি অগাধ বিশ্বাস-ভালোবাসা ছিল টুনির। মন্তু টুনিকে কথা দিয়েছিল- টুনির পছন্দ ছাড়া সে বিয়ে করবে না। সে বিশ্বাসের জোড়েই- সবাই যখন মন্তু ও আম্বিয়ার বিয়ের ব্যাপারে কথা বলতে চায় তখন টুনি জোর গলায় জানিয়ে দেয়- মন্তু কইছে আম্বিয়াকে বিয়া করবো না। সবাই মন্তুকে ডাকতে চাইলে টুনি বললো, ডাহন লাগবে না ওরে, আমারে কইছে বিয়া কইরবো না।

টুনি কোনোভাবেই মন্তুকে হারাতে চাইছিল না। তারপরও বাপ-মা সব হারানো আম্বিয়ার আশ্রয় হিসেবে সবাই যখন মন্তুর সাথে তার বিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছিল, তখন টুনি তার সবটুকু দিয়ে সর্বাত্মক চেষ্টাটুকু করে। নিজের স্বামী বুড়ো মকবুলকে ফুঁসলিয়ে ৪র্থ স্ত্রী হিসেবে আম্বিয়াকে গ্রহণ করতে বলে। তিনকুলে আম্বিয়ার আর কেউ না থাকায় তার সকল সহায়–সম্পত্তি মকবুলের হয়ে যাবে; এ লোভ দেখায়। এ চেষ্টায় কিছুটা হলেও টুনি সফল হয়। তবে ঘটনা এতো বিস্তৃত রূপ নিবে তা তার ধারনায় ছিল না। মকবুলের ৪র্থ বিয়েতে রাজি না হওয়ায় সে তার বড় দুই বউকে তালাক দেয়। ঘটনার আকস্মিকতায় মকবুলের মৃত্যু হয়। আর এসবের জন্য টুনি নিজেকে অপরাধী ভাবতে থাকে।

 মকবুলের মৃত্যুর দিন তিনেক পর নৌকা নিয়ে বাইরে যাবার জন্যে তৈরি হচ্ছিলো মন্তু।

টুনি ডাকলো, শোন।

মন্তু তাকিয়ে দেখলো কয়দিনে ভীষণ শুকিয়ে গেছে টুনি।

চোয়ালের হাড় দুটো বেরিয়ে পড়েছে। চোখের নিচে কালি পড়েছে তার। মুখখানা বিষণ্ণ। মাথায় ছোট একটা ঘোমটা।

মন্তু বললো, কি।

টুনি চারপাশে তাকিয়ে নিয়ে আস্তে করে বলো, আমার একটা কথা রাইখবা?

মন্তু বললো, কও।

মাটির দিকে তাকিয়ে থেকে কিছুক্ষণ কি যেন ভাবলো টুনি। তারপর আস্তে করে বললো, আমারে একদিন সময় কইরা আমাগো বাড়ি পৌঁছাইয়া দিয়া আইবা? টুনির চোখজোড়া পানিতে ছলছল করছে।

 

বুড়ো মকবুল মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে বাড়ির সাথে সকল সম্পর্ক শেষ হয়ে গেছে টুনির। আর কতদিন এখানে এমনি করে পড়ে থাকবে সে।

মন্তু আস্তে করে বললো, ঠিক আছে যামুনি। কোন্ দিন যাইবা?

টুনি মৃদু গলায় বললো, যেই দিন তোমার সুবিধা হয়। বলতে গিয়ে কেঁদে ফেললো সে।

মন্তু বিব্রত বোধ করলো। কি বলে যে ওকে সান্ত্বনা দেবে ভেবে পেলো না সে।

টুনি একটু পরে কান্না থামিয়ে বললো, বড় ইচ্ছা আছিল তোমার বিয়া দেইখা যামু, তোমার হাতে মেন্দি পরায়া দিমু। থাকন গেলো না।

কথার আর উত্তর দিলো না মন্তু। গাঁয়ের সবাই জানে সামনের শীতে আম্বিয়াকে বিয়ে করছে ও। টুনিও জানে।

কাপড়ের আঁচলে চোখের পানি মুছে টুনি আবার বললো, বিয়ার সময় আমারে নাইয়র আনবা না?

নিস্তেজ গলায় মন্তু পরক্ষণে বললো, আনমু।

সহসা ওর চোখের দিকে মুখ তুলে তাকালো টুনি। এক টুকরো ম্লান হাসিতে ঠোঁটজোড়া কেঁপে উঠলো ওর। আস্তে করে বললো, কথা দিলা মনে থাহে যেন।

মন্তু বললো, থাকবো।

একে একে বাড়ির সবার কাছ থেকে বিদায় নিল টুনি। সবার গলা জড়িয়ে ধরে কাঁদলো সে। ভাটার স্রোতে নৌকো ভাসিয়ে দিলে মন্তু। সেই নৌকো। যার মধ্যে ছড়িয়ে টুনিকে তার বাবার বাড়ি থেকে নিয়ে এসেছিলো সে। টুনি ছইয়ের মধ্যে চুপচাপ বসে রইলো মাথায় ছোট একখানা ঘোমটা।

মন্তু সহসা বললো, বাইরে আইসা বস না। গায়ে বাতাস লাইগবো।

টুনি পরক্ষণে বললো, আইতাছি। কিন্তু সহসা এলো না সে।

এলো অনেকক্ষণ পরে।

বাইরে কাঠের পাটাতনের উপরে ছোট হয়ে বসলো টুনি।

সেই নদী। পুরনো নদী। আগে যেমনটি ছিলো তেমনি আছে।

আজ নদীর জলে হাতের পাতা ডুবিয়ে খেলা করলো না টুনি।

উচ্ছ্বল দষ্টি মেলে তাকালো না কোন দিকে।

শুধু বললো, আম্বিয়ারে বিয়া কইরলে এই নাওডা তোমার অইয়া যাইবো না?

মন্তু সংক্ষেপে বললো, হুঁ।

টুনি বললো, বিয়ার পরে এই বাড়িতে থাইকবা, না আম্বিয়াগো বাড়ি চইলা যাইবা?

কথার কোন জবাব দিলো না মন্তু। সে শুধু দেখলো, ঘোমটার ফাঁকে এক জোড়া চোখ গভীর আগ্রহে তাকিয়ে রয়েছে ওর দিকে।

উত্তর না পেয়ে টুনি আবার বললো, চুপ কইরা রইলা যে?

মন্তু হঠাৎ দূরে আঙ্গুল দেখিয়ে বললো, শান্তির হাট।

টুনি চমকে তাকালো সেদিকে। ভাটার স্রোত ঠেলে নৌকোটা ধীরে ধীরে এগিয়ে চলেছে শান্তির হাটের দিকে।

সহসা জোরে জোরে দাঁড় টানতে লাগলো মন্তু। একটা ঝাঁকুনি দিয়ে দ্রুত এগিয়ে গেলো নৌকো। পড়তে গিয়ে সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে সামলে নিলো টুনি। মাথার উপর থেকে ঘোমটাটা পরে যেতে পরক্ষণে সেটা তুলে নিলো আবার।

মন্তু এক দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে রয়েছে। গভীরভাবে কি যেন দেখছে সে।

নৌকোটাকে ঘাটের দিকে এগোতে দেখে টুনি বললো, ঘাটে ভিড়াইছ ক্যান, নামবা নাকি?

মন্তু চুপ করে রইলো।

টুনি আবার বললো, হাটে কি কোন কাম আছে?

মন্তু মুখখানা অন্যদিকে সরিয়ে নিয়ে হঠাৎ মরিয়া গলায় বললো, মনোয়ার হাজীরে কথা দিছিলাম ওর ওইখানে এক রাইতের লাইগা নাইয়র থাকমু। চল যাই।

টুনির দেহটা ধরে কে যেন একটা সজোরে নাড়া দিল। মুহূর্তে চোখজোড়া পাথরে মত স্থির হয়ে গেলো ওর। মন্তুর মুখের দিকে পলকহীন দৃষ্টিতে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলে সে।

মন্তু আবার বললো, মনোয়ার হাজীরে কইলে মোল্লা ডাইকা সব ঠিক কইরা দিবো।

আবেগে গলাটা কাঁপছে ওর।

টুনির চোখের কোণে তখনও দুফোঁটা জল চিকচিক করছে। অত্যন্ত ধীরে ধীরে মাথাটা নাড়লো সে। আর অতি চাপা স্বরে ফিসফিস করে বললো,

-না, তা আর অয় না মিয়া। তা অয় না।

বলতে গিয়া ডুকরে কেঁদে উঠলো সে। হাতের বৈঠাটা ছেড়ে দিয়ে বোবা চাউনি মেলে ওর দিকে তাকিয়ে রইলো মন্তু। একটা কথাও আর মুখ দিয়ে বেরুলো না ওর।

No comments

Theme images by Maliketh. Powered by Blogger.